Skip to main content

মিত্তির মশায় আলি সাহেবের কবরের সামনে এসে প্রায় প্রতি রবিবার বিকেলে বসেন। দুজনেই ছেলেবেলার বন্ধু, প্রাণের বন্ধু ছিলেন। কর্মসূত্রেও সারাটা জীবন কাছাকাছিই থেকে গেলেন। কিন্তু ভাগ্যের খেলায় আলি সাহেব চলে গেলেন মাত্র কয়েকদিন জ্বরে ভুগে। সবাই বলল, স্বাভাবিক সময়েই গেলেন। কিন্তু মিত্তির মশায়ের মন বলল, তাই কি? তবু মেনেই নিলেন, কারণ কথাটা সংসারের হিসাবে তো সত্যি।

    মিত্তির মশায় রবিবার বিকালে কয়েক ঘন্টা কবরের পাশে বসে থাকেন। চুপ করে পাখির ডাক শোনেন। কাঠবেড়ালির গাছে ওঠা, মাঠে ঘোরা দেখেন। ফেলে আসা জীবনটার আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান। মাঝে মাঝে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। মাঝে মাঝে ঠোঁটের কোনে হাসির ছোটো নদী যেন জেগে ওঠে। আবার কখনও দুটো চোখ সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে উদাসীন। মিত্তির মশায়ের খুব ইচ্ছা আলিসাহেবের পাশেই যদি ওনাকেও জীবনের পরের জীবনটা কাটাতে দিত সমাজ। দুই বন্ধু কয়েক হাত দূরত্বে মাটির নীচে শুয়ে থাকতেন। মাটির উপর দিয়ে বর্ষা, বসন্ত বয়ে যেত। তারা শুধু অনুভব করতেন। এমনিতেও জীবনের কাছে খুব বিশেষ কিছু চাহিদা ওদের দুজনেরই কিছু তেমন ছিল না। বেশ শান্তিতেই কেটেছে। অভাব অভিযোগও ছিল না কিছু। সব কিছু শেষ হলে থাকতেনই না হয় পাশাপাশি। 

    একদিন ভোরে মিত্তির মশায় মারা গেলেন। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। শ্মশানের রাস্তাটা কবরস্থানের পাশ দিয়েই। মিত্তিরমশাইকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সঙ্গে দুই ছেলে, নাতি, আরো অনেকে। মিত্তির মশায়ের চোখে তুলসীপাতা। গায়ে নামাবলী। যদিও মিত্তির মশায় বা আলিসাহেব ধর্ম নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি কোনোদিন। কিন্তু মৃত মানুষ তো যায় সমাজের হেফাজতে। 

    মিত্তির মশায়কে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শ্মাশানের দিকে, তখন আলিসাহেবের বড় ছেলে ঢুকছে ফুল নিয়ে কবরস্থানে। মিত্তির সাহেবের ছেলেকে দেখে চমকে উঠে বলল, আব্বাও তো আজকের দিনেই... আমি ফুল দিতে এসেছি.... তোমরা এগোও.. আমি আসছি..

    আলিসাহেবের ছেলে শ্মশানে এলো। পায়ে লেগে কবরস্থানের নরম মাটি। গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে খুব। সেই মাটির দাগ পড়ল শ্মশানে। সে মাটির উপর শোয়ানো মিত্তির মশায়ের খাট। মাটি লাগল খাটে। 

    ফেরার সময় মিত্তির মশায়ের বড় ছেলে বলল, চলো আলিচাচাকে একবার দেখে আসি। মিত্তির মশায়ের বড় ছেলে এসে দাঁড়ালো আলিসাহেবের কবরের পাশে। মিত্তির মশায়ের বড় ছেলের পায়ে লেগে শ্মশানের মাটি, সে মাটি মিশে গেল কবরের মাটির সঙ্গে। 

    এ সব কিছুই হত না, যদি না গতকাল বৃষ্টি হত রাতে। আসলে আকাশ, বৃষ্টি, মাটি আর ভালোবাসা মানুষকে চেনে অনেকদিন, মানুষের ধর্ম বানানোর আগে।