হেরম্ব বিশ্বাস মহাশয় মস্তকে ছাতা, গায়ে হাফ সোয়েটার নিয়ে গ্রীষ্মের ঘামের ন্যায় স্নাত হইতেছিলেন। রাস্তার চৌমাথায় দাঁড়াইয়া ইতিউতি চাহিয়া যাহা খুঁজিতেছিলেন, তাহা হইল একটি বিশুদ্ধ প্রস্রাবাগার। বৃষ্টি পড়িলে তাহার রেচনাবেগ কিঞ্চিৎ বর্ধিত হয়। লোকমুখে শ্রুত হয় তাহার বাল্যকালে বর্ষাকালে আশেপাশের গ্রাম হইতে গোযান করিয়া কাঁথা আসিত।
হেরম্ববাবুর অবস্থা ক্রমশ গম্ভীর হইয়া উঠিতেছে। চাপ যে অবস্থায় পৌঁছাইয়াছে, তাহাকে লঘুভাবে দেখিবার কোনো অবকাশ নেই। এমন সময় একটা মাছি আসিয়া হেরম্ববাবুর কর্ণমূলের ঠিক নীচে বসিল। কিঞ্চিৎ সুড়সুড়ি অনুভব করিবা মাত্র হেরম্ববাবুর তলপেট যেন একখানি মোচড় দিয়া আরো অবাধ্য হইয়া উঠিল। তিনি শঙ্কিত হইয়া আপনার ধুতির তলদেশ নিরীক্ষণ করিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিলেন, যে অংশটি সিক্ত হইয়াছে তাহা জৈব তরলে অথবা প্রকৃতির নানা নদ-নদী- সাগর সিঞ্চিত বারিধারায়। নিরীক্ষণ করিয়াও যখন সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে ব্যর্থ হইলেন, তখন ডান হস্তে ছত্রখানি ধরিয়া, বামহস্তের তর্জনী আশঙ্কিত স্থানে বুলাইয়া ঘ্রাণ লইলেন। ঘ্রাণ লইবা মাত্র তাহার ওষ্ঠযুগলে সদ্য কর্তিত একফালি তরমুজ সদৃশ হাস্যরেখা দেখা দিল - ইহা বৃষ্টিবারি সিক্ত দাগ, রেচিত কলঙ্ক নহে।
কিন্তু মুহূর্তেই তার স্মিতহাস্য তপ্ত তাওয়ায় নিক্ষিপ্ত জলের ন্যায় উধাও হইল। মাছি। সেই মাছির পদমালিকার সুক্ষ্ম, কোমল সঞ্চারণ তাহার কর্ণমূলের চর্মকে চঞ্চল করিয়া তুলিতেছিল। হেরম্ববাবুর স্থিতধী অবস্থার পরিবর্তন ঘটিল। তিনি সজোরে তাহার বামহস্ত আপন মুখমণ্ডলের উপদ্রবাক্রান্ত অঞ্চলে সঞ্চালিত করিলেন। মাছি উড়িয়া গেল, তাহার মোটা কাঁচের চশমাটি সে আঘাতে আপন স্থৈর্য হারাইয়া ভূমিতে লুণ্ঠিত হইল। মুহূর্তেই বিশ্ব চরাচর হেরম্ববাবুর সামনে আপন মাধুর্যময় শোভা, বর্ণ হারাইয়া ঝাপসা হইয়া গেল।
হেরম্ববাবু স্তম্ভিত হইয়া কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়াইয়া রহিলেন। কি ঘটিয়াছে বুঝিয়াও তাহাতে প্রতিক্রিয়া জানাইতে তাহার কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইল। বিদ্যালয়েও এরূপ হইত। যতবার তিনি গণিতের পরীক্ষায় পাশ করিতে অসমর্থ হইতেন, ততবারই স্তম্ভিত হইয়া ফলপত্র হাতে করিয়া জগদ্দলের ন্যায় দাঁড়াইয়া থাকিতেন, যতক্ষণ না শিক্ষক কিম্বা অন্য কোনো অভিভাবক দয়াপরবশ হইয়া তাহার অঙ্গে তাহাদের শ্রীঅঙ্গ চালনা না করিতেন।
এই ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হইল না। খানিক বিলম্ব করিয়া হেরম্ববাবু ঝুঁকিয়া হাতড়াইয়া চশমাটি খুঁজিবার চেষ্টা করিলেন, পাইলেন না। পাইবেন কি করিয়া। উহা পতিত হইবামাত্র ভুলু নামক সারমেয় উহা মুখে করিয়া প্রায় নৃত্য করিতে করিতে পলায়ন করিয়াছে। ভুলু অবশ্যই উহাকে খাদ্যই মনে করিয়াছে। কারণ ভুলুর আপনার দৃষ্টিশক্তির উপর কোনো সংশয় আসিয়াছে বলিয়া প্রাণীকুল শ্রবণ করে নাই।
সংসারে সব কিছুর একটা সীমা আছে। পুষ্করিণী, তড়াগ, নদী-নালা, সাগর সকলেরই একটা ধারণ ক্ষমতা আছে। তাহার অধিক হইলে প্লাবন হইবার আশঙ্কা থাকে। জনসমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া পড়ে। হেরম্ববাবুর নিকট হইতে যদিও মানবসমাজের কোনো আশঙ্কা ছিল না, কিন্তু তাহার ধুতির ও তাহার মান-সম্মানের সে আশঙ্কা তো ছিল।
হেরম্ববাবু ইষ্ট স্মরণ করিয়া ডানদিকে হাঁটিতে শুরু করিলেন, ওইদিকেই শেষ প্রস্রাবাগারটি দেখিয়াছেন। কিন্তু চিনিবেন কি করিয়া? ভাবিতে ভাবিতে, চলিতে চলিতে সে সমাধান হইয়া গেল। সেই অশুদ্ধ, অসংস্কৃত প্রস্রাবারের দুর্গন্ধই তাহার নিকট এইক্ষণে পারিজাতের আঘ্রাণের মত বোধ হইল। পাঠককূল প্রশ্ন করিতে পারেন, হেরম্ববাবু কি পারিজাতের আঘ্রাণ পাইয়াছিলেন পূর্বে? সেই সন্দিগ্ধ চিত্ত পাঠককূলকে বলি, হে পাঠক, তোমার যখন ঘড়া পূর্ণ হইয়া মধ্যপথে অসংযমী হইবার উপক্রম ঘটিবে, তখন তুমিও এমন সমাধানের দ্বারে আসিয়া পারিজাতের সুগন্ধ কি, স্বয়ং পরমানন্দের বোধে সমাধিও যাইতে পারো।
যাহা হউক, হেরম্ববাবু কর্মটি সমাপন করিয়া যখন পথাভিমুখে ফিরিলেন, তখন ওনার মনে হইতে লাগিল তিনি যেন বৃন্দাবনে আপন ইষ্ট সমভিব্যাহারে লীলা করিতেছেন। এমন সময় কে একজন আসিয়া কহিল, "এই যে দাদা, এটা কি আপনার চশমা?" সে আগন্তুক আরো কহিল, তাহার ভুলু কিঞ্চিৎ লেহন করিয়াছিল, সে মুছিয়া লইয়া আসিয়াছে..ইত্যাদি বলিতে বলিতে সে হেরম্ববাবুর চোখে পরাইয়া দিল। মুহূর্তেই হেরম্ববাবু তাহার সম্মুখে সজলা, সুফলা, বর্ণময় জগতে ফিরিয়া পাইলেন। হাসিমুখে আপনার উদ্ধারকর্তার প্রতি চাহিয়া বলিলেন, কি নাম মহাশয় আপনার? উদ্ধারকর্তা মাথাটি নিম্ন হইতে ঊর্দ্ধে তুলিয়া বলিলেন, "মাছি। আমায় সবাই ওই নামেই ডাকে, আপনিও ডাকতে পারেন, শুধু স্যার ধুতিটা পরে নিন প্লিজ, এই অবস্থায় এমন বাজারের মধ্যে ঠিক দেখাচ্ছে না"।
যথারীতি হেরম্ববাবু পুনরায় স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন খানিকক্ষণ। সামনের পথচারীদের কৌতুক দৃষ্টিতে বিদ্ধ হইয়া নীচের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, শুধু অন্তর্বাস পরিয়া দাঁড়াইয়া। ধুতিটি এত জোরের সহিত টানিয়াছিলেন, তাহাতে উহা যে তাহার দেহচ্যুত হইয়া ভূলুণ্ঠিত হইয়া রহিয়াছে খেয়াল করেননি। সিক্ত ধুতি। কি কারণে সিক্ত বুঝিতে তাহার বিলম্ব হইল না। সেই সিক্ত ধুতি পরিধান করিয়াই, ছত্রখানি বন্ধ করিয়া মাঘের এই অকাল বর্ষণে স্নাত হইতে হইতে হাঁটিতে লাগিলেন। সহসা তাহার লজ্জা, সংকোচ কোথায় উধাও হইয়া গেল। বাল্যকালের স্মৃতিরা ভিড় করিয়া শিলাবৃষ্টির মত তাহার মনের উপর পড়িতে লাগিল। মায়ের হাতের খিচুড়ি, উলঙ্গ হইয়া বন্ধুদের সহিত পুষ্করিণী স্নান, স্মরণে তীরের মত বিঁধিতে লাগিল। সব যেন কোথায় হারাইয়া ফেলিয়াছিলেন। আজ অকাল বর্ষণ সে ফিরাইয়া দিয়া গেল।
তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন। বৃষ্টির জলের সাথে চোখের জল মিলিয়া একাকার হইয়া গেল। অকাল বর্ষণে হেরম্ববাবু হাঁটিয়া চলিলেন, চলনে যেন কৈশোরের দোলা।
(ছবিঃ সুমন)