Skip to main content
অজগর

(কাল - প্রাক্ স্বাধীনতা; স্থান - বাংলার অখ্যাত একটি গ্রাম)



---
 
রাস্তাটা খানিক জটিল ছিল বোধহয়। না হলে এতটা আলোছায়া তার মনে উঁকি দিত না। 
 
একটা মরা গাছের নীচে বসে সনাতন ভাবছিল। এ গ্রামটার উপর তার তেমন কোনো টান নেই। তবে ছেড়ে যেতেও মন চাইল না কেন কে জানে? সে এ গ্রামটার নাড়ীনক্ষত্র জানে। পুকুরের ধারের, ঝোপঝাড়ের, চাষের জমির সব গন্ধ তার চেনা। এমনকি বাড়ির ভিতরের গন্ধগুলোও। সবার বাড়ির আলাদা আলাদা গন্ধ।
 
আশ্বিন মাসের এই সময়টা সনাতনের খুব একা লাগে। সব সময় না, মাঝে মাঝে। বিশেষ করে এই বেলার দিকটা। তার তিন কূলে কেউ নেই এখন। কি করে করে বয়েসও হল চল্লিশের কোঠায়। বিয়ে করেনি। কেন করেনি তার নিজের কাছেও স্পষ্ট না। একটা কারণ অবশ্য আছে। সে তেমন কোনো কাজ করে না। অপটু বা কুঁড়ে, এসব তার নিজেকে মনে হয়নি কোনোদিন। তবু কেন যেন কিছুই তেমন করা হল না জীবনে। তার মাঝেমাঝেই এই দীর্ঘশ্বাসটা পড়ে। কি করে কাটাল এতটা কাল?
 
এখন হাতে তেমন কাজ নেই। বাড়িতে তার একার পেট কোনোরকমে চলেই যায়। তাছাড়া তার না আছে কিছু নেশা, না আছে খুব খাবার শখ। পেট ভরলেই হল। 
 
সকাল থেকে সেরকম কিছু খাওয়া হয়নি। খিদে একটু একটু লেগেছে। গ্রামের এই দিকটায় তেমন কেউ আসে না। সকালেই যা আসে, বাহ্যে। সনাতনের খিদে পেলে শরীরটা বড় টাটায়। কেমন একটা অস্থির অস্থির লাগে। শরীরের মধ্যে যেন একটা বড় অজগর ফুঁসছে মনে হয়। পেটের নীচের অঙ্গটা অকারণে ছ্যাঁতছ্যাঁত করে। তার জ্বর জ্বর লাগে। এটাকেই কি কামজ্বর বলে? সনাতনের হাসি পায়। সে গাড়ুটা রেখে পুকুরে নেমে পড়ে। আঃ... তার শরীরটা জুড়ায়।



---
 
স্নান সেরে উঠতেই খিদেটা চড়চড় করে বেড়ে গেল। বকুল পিসির বাড়ি যাবে? সে তার দুঃসম্পর্কের পিসি। তাদের বেশ সচ্ছল অবস্থা। তার পিসতুতো ভাই মদন চাষবাসে মন দিয়ে বাড়িতে শ্রী ফিরিয়ে এনেছে। সেখানে গেলে এবেলাটা রান্নার হাত থেকে বেঁচে যায় সে। ভাবতে ভাবতে, হঠাৎই তার বিমুর মুখটা মনে পড়ে গেল। বিমু মদনের স্ত্রী। থাক। তার আবার সেরকম জ্বর জ্বর লাগছে।
 
সে পিসির বাড়ির পথ ছেড়ে, শিব মন্দিরের দিকের আলপথ ধরল। খুব নির্জন এদিকটা। আচমকাই মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে গেল। গেলবার যাত্রায় শোনা একটা গান শিস দিয়ে গাইতে গাইতে সে লাফিয়ে লাফিয়ে চলল। তার দেহের গঠন দেখে অবশ্য তার বয়েস বোঝা যায় না এখনো। বেশ ছিমছাম। টানটান চামড়া। আবার তার বিমুর মুখটা মনে পড়ল। মনে পড়ল? নাকি মনেই ছিল? খুশীর ছলকটাও তারই জন্যে। যাঃ!
 
সনাতন শিবমন্দিরের ধারেকাছে এসে পড়েছে প্রায়। তার বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে! আরে কে ওটা, বিমু না? 
 
সনাতনের পেটের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। হাত-পা আচমকাই হিম হয়ে গেল। অজগরটা যেন গুহা ছেড়ে বেরোচ্ছে। তাকে গিলতে। 
 
সে ধীর পায়ে যন্ত্রের মত মন্দিরের দিকে এগোচ্ছে। তার নিজের বুকের আওয়াজ সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে। আশপাশে চকিতে তাকিয়ে নিল। না কেউ নেই। সে মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। সে উঠছে? না অজগরটা ফুঁসতে ফুঁসতে উঠছে। তার মাথার ভিতরটা ভোঁ ভোঁ করছে। কানের থেকে গরম হাওয়ার মত কি বেরোচ্ছে। অজগরটার বিষ নিশ্বাস। তার শ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। বিমু হেসে কি একটা বলছে। তার সারা শরীর ঘামছে। জ্বরে গা পুড়ছে।
 
সে মন্দিরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। ধড়াস্!!!



---
 
মন্দিরের দরজা খুলল। সনাতন ধুতিটা কোনো রকমে জড়িয়ে ছুটছে। খালি গা। সে পাগলের মত ছুটছে। তার কানে গোঙানির শব্দ... ঠাকুরপো.... ঠাকুরপো....
 
তার সারা পিঠে আঁচড়ের দাগ। রক্ত পড়ছে নিশ্চই। ভিজে ভিজে লাগছে। জ্বালা জ্বালা করছে। সে দৌড়াচ্ছে। তার মাথাটা শীতকালের কুয়াশা ঘেরা ফাঁকা মাঠের মত। সে কে? নিজেকে খুব অচেনা লাগছে। অজগরটা মন্দিরে। বিমুর সাথে।
 
তার পুরো সম্বিৎ ফিরল যখন সে কলকাতায়। তার এটুকু মনে আছে দৌড়াতে দৌড়াতে সে একটা বাস পেয়ে যায়। টিকিট কাটার পয়সা না থাকতেও কন্ডাক্টার তাকে কিছু বলেনি। সে বলেছিল, বাবা মারা গেছে সদর হাসপাতালে বহরমপুরে। চাষের মাঠে খবর পেয়েছিল, সেই অবস্থায় ছুটতে শুরু করেছে। 
 
তার মাথায় এখন অজগরের বাচ্চারা। কি করে এত কম সময়ে এত মিথ্যা বানাল! একজন ভদ্দরলোক দয়াপরবশ হয়ে তাকে দু'টাকা দিল। বলল, আহা রে, এ সময়ে মাথার ঠিক থাকে! তার হাসি পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন লোকটার মুখে হিসি করে দিল। ভিতর থেকে অজগরের বাচ্চাগুলো হিস হিস করছিল।
 
সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হল। কিছু খেল না। হেঁটে হেঁটে কাটিয়ে দিল। সবসময় তার মনে হচ্ছে, তার পিছনে কে? পুলিশ? মদন? পিসি? না বিমু?
 
সারা শরীর অবসন্ন। একটা ফাঁকা মাঠের পাশে রাখা ঠেলাগাড়ির উপরে শুয়ে পড়ল। 
 
ঘুম ভাঙল যখন তখনও দিনের আলো ফোটেনি। বেশ অন্ধকার। রাস্তার আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে তার ভয় ভয় করে উঠল বুকটা। তারপর মনে হল, যাঃ শালা। 
 
উঠে পড়ল। হাঁটতে গিয়ে টলে গেল। পায়ে বিষ ব্যাথা। পা'টা নড়ছে না। একটু আলোর দিকে এনে দেখল ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। আবার ঠেলাগাড়িটার উপর এসে বসে পড়ল। 
 
মন্দিরের ভিতরটা খুব অন্ধকার ছিল না। তার বিমুর শরীরটা মনে পড়ছে। অজগরটা আবার জাগছে। সে চেপে ধরল নিজের অঙ্গটাকে। ছিঁড়েই ফেলবে শালা। 
 
পারল না। বিমু এসে হাত চেপে ধরল। তার থাই গড়িয়ে বিষ পড়ল কাপড়ে। অজগরের ফোঁসানিটা কমল।



---
 
সনাতনের মাথাটা আজকাল সবসময় ভোঁ ভোঁ করে। খুব ভীড় রাস্তায় চলতে পারে না। মাথাটা টলে। দুর্বলতাটা বুঝতে পারে। কে বলল, ওই মন্দিরে দুপুরে খাওয়ায়। মন্দিরে ঢুকতে গিয়ে পড়ল একটা বড় শিবমন্দির। সে মাথা ঘুরে বসে পড়ে। তাকে সেখানেই শালপাতা করে কেউ কিছুটা খিচুড়ি দিয়ে যায়। বলে, প্রসাদ, খেয়ে নাও। সে একদলা খেতেই বমি করে ফেলে। কে যেন অজগরটার মাথায় লাথি মারতে মারতে বলে, ফেল শালা, ফেল! পাপী! অধম! আমার মন্দিরকে অপবিত্র করলি!
 
সে প্রসাদ ফেলে ছোটে। আবার ট্রেনে ওঠে। কখনো অচেনা শহর, কখনো গ্রাম। কখনো ভিক্ষা, কখনো না খাওয়া। তার মনে হয় আজকাল তার আর মাথা, কান, চোখ, মুখ নেই। তার অঙ্গটা যেন শুধু বড় হয়ে যাচ্ছে। তার গলায় পেঁচিয়ে তাকেই মারতে চাইছে। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে সে। 
 
একদিন দেখল বিমুর যোনির মধ্যে শিবলিঙ্গ। স্তনদুটোও যেন শিবলিঙ্গ হয়ে গেছে। অজগরটা ছোবল মারছে শিবলিঙ্গগুলোকে। সনাতনের দিকে বিমু তাকাতেই একটা ত্রিশূল তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে গেল।

একদিন সনাতনের উলঙ্গ দেহ পাওয়া গেল আন্দুলের একটা শিবমন্দিরের পাশের বটগাছে। সেই জরাজীর্ণ ধুতিটা দিয়েই গলায় দড়ি দিয়েছিল। 
 
মর্গে বেশ কিছুদিন বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে পড়ে থাকল। কেউ নিতে এল না।

বিমুর একটা খুব সুন্দর দেখতে ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। নাম রেখেছে সদাশিব। মদন চাষের কাজ ছেড়ে বোম্বাইতে গেছে। কে নাকি বন্ধু আছে সেখানে, সে ভাল কাজের সন্ধান দিয়েছে। মদনের গ্রামে মন টিকছে না। বিমুর শাশুড়ি আশ্চর্য হয়ে গেল বৌমার ব্যবহার দেখে, সে একটা রা-ও কাটল না! কেমনধারা মেয়েমানুষ গো! বরটাকে বিবাগী করে ছাড়লি!
 
সদাশিব গ্রামেই বড় হতে লাগল। তবে কেউ কেউ যেন কার একটা মুখের আদল পায় সদাশিবের মুখে। ঠিক মনে করতে পারে না। নাকি জিভে আসে না, তারাই জানে।

(ছবিঃ সুমন)