টিপটিপ করে বৃষ্টিটা হয়েই যাচ্ছে সকাল থেকে। পরমা চোখ খুলে দেখল সে আজকেও মারা যায়নি। পায়ের নীচের দিকের দরজাটার দিকে তাকালো। সবুজ পাল্লা দুটো খোলা। বাইরে অনেকের কথা বলার আওয়াজ। ক'টা বাজে? ন'টা না দশটা? যা মেঘলা হয়ে আছে। তার ঘরে ঘড়ি নেই। আজকে মারা যাওয়ার কথা ছিল। কি একটা স্বপ্ন দেখেছে কাল রাতে, মনে আসছে না, মাথাটা ভার হয়ে আছে। সবার চা খাওয়া হয়ে গেছে?
পরমার স্নায়ুর অসুখ। কয়েকদিন এরকম অসাড় হয়ে শুয়ে থাকে। কথা জড়িয়ে যায়। হাত-পা কাঁপে, তারপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়। ছেলেটা কাজে গেছে? বউমা কি নাতিকে (সাড়ে চার বছর বয়স) স্কুলে নিয়ে গেছে? কাল সারারাত মাথার কাছে জেগে বসেছিল তার স্বামী, পরমা মনে করার চেষ্টা করল। আসলে তা নয়, বিশ্বনাথ পরমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নিজেও আড়াইটে নাগাদ শুয়ে পড়ে। তার নিজেরও শরীর ভালো নয়। বয়েস তেষট্টি হল। পরমার চুয়ান্ন। রঙের মিস্ত্রী ছিল বিশ্বনাথ। তাদের একমাত্র ছেলে অজিত, মাষ্টার ডিগ্রী পাস করে বড় কিছু একটা চাকরি পায়নি। কলকাতায় একটা প্রাইভেট ফার্মে এটা ওটা লেখালেখির কাজ করে, সামান্য মাইনে।
বাড়ির সামনে একটা পুকুর আছে, সেখানেই বসে থাকে বিশ্বনাথ প্রায় সারাদিন। শরীরের কলকব্জাগুলো জবাব দিচ্ছে। পরমার অসুখটা আরো বুড়ো করে দিল তাকে। পুকুরে ছিপ ফেলে বসে থাকে। ছিপের মাথায় চারা থাকে না। মাছ উঠুক সে চায় না। সে চায় অতীতে ডুবতে। সচ্ছল ছিল না কোনোদিন, আনন্দ ছিল। পরমা খুব ভালো মেয়ে। চাকদায় বাড়ি, রেললাইনের পশ্চিম দিকে, বিশ্বনাথের বাড়ি পুবের দিকে।
বিশ্বনাথ অন্যমনস্ক থাকে সারাদিন প্রায়। পরমার শরীরটা কেমন পোকায় খেয়ে যাচ্ছে। সহ্য হয় না। কি পাপ সে করেছিল? ভেলোর গিয়েছিল, ওরা সারবে না বলল। অত বড় বড় ডাক্তার, তারাই যদি বলে... অথচ কত লোকের কত অসুখ সেরে বাড়ি চলে আসছে, হেসেখেলে জীবন কাটাচ্ছে। কপাল! এই জিনিসটা আর বদলালো না, বিশ্বনাথ ভাবে। ছোটোবেলায় বাবা মরল। সে রঙের কাজে নামল। নইলে বাড়ির অতগুলো মানুষের পেট চলত কি করে? চারটে ভাই, সে সবার বড়ো, তার নিজের বয়েস তখন কত, বারো হবে। তারপর ভ্যান টানা ধরল। চাকদা স্টেশানে লোক নিয়ে যেত অফিস টাইমে। বিয়ে করল পঁচিশ বছর বয়সে। দু'বছর পর হার্ণিয়া ধরল। ডাক্তার বলল, আর ভ্যান টেনো না। সেই থেকে শুধু রঙের কাজ। মাষ্টার ডিগ্রী করার পর ছেলেটার স্কুলে একটা হিল্লে হয়ে যেত হয়ত, কিন্তু অত টাকা কোথায় যে বাবুদের খাই মেটাবে।
পরমাকে খাইয়ে গেল সুজানা, পরমার বউমা। অজিতের প্রেম করে বিয়ে। সুজানারা ব্রাহ্মণ। অবস্থা ভালো নয়, নইলে ওর বাবা যা গোঁড়া, সদগোপ পরিবারে মেয়ে দিত? কক্ষনো না। বেলা বাড়ল। পরমার একটু ভালো লাগছে। কাঁপাটা বন্ধ হয়েছে। এবারে ছ'দিন প্রায় বিছানায় ছিল। পরমা আগে বিড়ি বাঁধা, ঠোঙা বানানোর কাজ নিত। এখন আর পারে না। হাত-পা কাঁপে। সময়ে মাল ডেলিভারি দিতে পারে না। যদিও বাড়িতে এই নিয়ে কেউ কিছু বলে না, তবু এটা সেটা করে খরচ তো হয়, চলে কি করে... তাদের দিন তো আর নেই। তা ছাড়া যা জমানো ছিল তার বেশ কিছুটা তো ভেলোরে গিয়েই ফুরিয়ে গেল। প্রথম দিকে যাবে না-ই ভেবেছিল, তারপর মনে হল যদি সেরে যেত তবে আরো বেশি বেশি অর্ডার নিয়ে টাকাটা পুরিয়ে নিত, কিন্তু হল কই।
পরমা উঠতে পারল। বাইরের বারান্দায় এসে টুলে বসল। বিশ্বনাথ ফেরেনি এখনও। পুকুরের ধারে আছে। এটা ওর বরাবরের স্বভাব। কিছু মনের বিরুদ্ধে হলেই পুকুরের ধারে বসে থাকবে। তাদের যখন বাচ্চা হচ্ছিল না তারা দু'জনেই প্রায়ই পুকুরের ধারে অনেক রাত বসে থাকত। সে হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। এমনকি একসাথে শুতেও চাইত না বিশ্বনাথ, বলত কি হবে শুয়ে... পশুর মত খালি দেহের সুখের জন্য? তারপর কে একজন কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে বলল। তারা গেল। তার সাথে হাজার একটা জায়গায় মানত করা তো ছিলোই, কিসের জোরে অজিত পেটে এলো কে জানে!
পরমা আজ নিজের হাতেই দুপুরের খাওয়া খেল। বিশ্বনাথের চোখে একটা প্রশান্তি। যেদিন পরমা সুস্থ হয়, বিশ্বনাথ সেদিন খুব খুশি খুশি থাকে, যদিও জানে আবার হবে, আরো ঘন ঘন হবে এটা। তবু সেটা ভুলেই খুশি থাকে। আজও হল। খুব সুন্দর তাকায় সে পরমার দিকে এই সময়টায়। পরমার করুণা হয়। কষ্ট হয়। কান্না পায়। কি পেল সারা জীবন মানুষটা?
পরমা শোয়ার ঘরে এসে খাটে বসল। মাথাটা অন্যদিনের চেয়ে আজ অনেক পরিষ্কার। স্বচ্ছ চিন্তা করতে পারছে। খাট থেকে উঠে আলমারিটা খুলল। তার বিয়ের আলমারি। বাবা দিয়েছিল। লকার থেকে গয়নাগুলো বার করল। সবক'টা গুনে দেখল। ঠিক আছে। বুকের ভিতর থেকে একটা ভার নেমে গেল। খাটে এসে শুলো। ঘুমালো না। ঘুম আসে আর এতদিন বিছানায় থাকার পরে? বাইরে এলো। বেশ গরম, বৈশাখের চোদ্দো তারিখ আজ। তার নাতি কবিতার রিহার্সাল দিতে যাবে সন্ধ্যেবেলা পাশের বাড়ি। সামনে রবীন্দ্রজয়ন্তী, পাড়ার ক্লাবে হবে, সব বাচ্চাকে নাকি একটা পেন দেবে, সুজানা বলছিল। পরমা বাগানের গাছগুলো ছুঁয়ে দেখল। কি সতেজ, তার নিজের ফেলে আসা দিনগুলোর মত। কিভাবে নদীর মত সময় কাটছিল, জোয়ার ভাঁটায়। হঠাৎ এমন বান আসবে কে জানত? মাথাটা একটু টাল খাচ্ছে। পরমা ঘরে গিয়ে শুলো আবার। বিশ্বনাথ নৈহাটি গেছে কিসের কাজে একটা, এসে বলবে বলল।
সুজানা সন্ধ্যে দিয়ে নাতিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ফিরতে একটু রাত হবে বলল। বৃষ্টি হচ্ছে না। গুমোট গরম। পরমা বাইরে এসে বারান্দায় বসল। চাঁদটা অর্ধেক খাওয়া। পরমার অনেক কাজ এখন। আঙুলের সোনার আঙটিটা, গলার সোনার চেনটা খুলে বালিশের তলায় রেখে এলো। ঠাকুর প্রণাম করল। স্বামীকে মনে মনে প্রণাম করল, বাবা-মা-গুরুদেবকে প্রণাম করে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল। তারপর রান্নাঘর থেকে কেরোসিনের জার আর দেশলাই নিয়ে এসে পিছনের দিকে কুয়োতলায় দাঁড়ালো। ভাবার সময় নেই। এত খরচ সামলানো যায় না। একটা বাচ্চা আছে তো... পড়াতে হবে তো... মানুষ করতে হবে তো... সে তো মা... পারবে না...? পারতেই হবে... সে তো এ বাড়ির বউ... পারতেই হবে..এত টাকার ওষুধ প্রতিমাসে...মানে হয়!.
সুজানাকে খবর দিল পারুল। সে তাদের বাড়ির পিছনে থাকে, তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে এসে দেখে দাউ দাউ করে কি একটা জ্বলছে মাটিতে পড়ে আর গড়াচ্ছে। সে বুঝতে পেরেই চীৎকার করে ওঠে... পরমাদি...!
পরমা হাস্পাতালে বারো ঘন্টাও বাঁচেনি। খুব কষ্ট করে অজিতকে বলেছিল, লকারে গয়নাগুলো আছে। বিশ্বনাথ বিছানায় শুলো। তার বালিশের নীচে পাঁচটা পুরীর টিকিট, রথের দু'দিন আগের দিনে ট্রেন, আর ক'টা দিন অপেক্ষা করতে পারল না?