Skip to main content

চেন্নাইতে করমণ্ডল ঢুকল বিকেলে। কাটপাডি যাওয়ার ট্রেন সন্ধ্যায়। কাটপাডি স্টেশান মানেই আমাদের চলতি ভাষায় যাকে বলি ভেলোর।

মা ভীষণ অসুস্থ। ট্রেন ছাড়ার পর মাকে খাওয়াতে হবে কিছু। চিঁড়ে ধুয়ে অল্প চিনি ছড়িয়ে মায়ের পাশে বসলাম। কিন্তু খাওয়াব কি করে? এক হাতে মায়ের মাথাটা ধরে, আরেক হাতে বাটিটা ধরে, এভাবে তো চলন্ত ট্রেনে খাওয়ানো যায় না। তবু দু একবার চেষ্টা করলাম। জানলার বাইরে দিয়ে আলোগুলো মাঝে মাঝে অন্ধকার ভেদ করে ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে। অসহায় লাগছে কিছুটা। আমি ভাবছি কিভাবে খাওয়াব। বোন সঙ্গে ছিল, কিন্তু সে বেচারি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

সামনের সিটে বসেছিলেন একজন মাঝবয়েসী মহিলা। একাই যাচ্ছেন। কেরালায়। ট্রেনটা কেরালায় যাচ্ছে। নিজের সিটে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিলেন।

একবার আমায় আড়চোখে দেখে, ইংরেজিতে বললেন, বাটিটা আমার হাতে দাও।

আমার উপায় নেই। বাটিটা ওনার হাতে দিলাম, কুণ্ঠায়। উনি একটু হাসলেন, বললেন, সঙ্কোচ কোরো না, ধীরেসুস্থে খাওয়াও।

উনি এক হাতে বাটিটা ধরে, আরেক হাতে বইটা পড়ছেন। আসলে তো পড়ছেন না, উনি বোঝাতে চাইছেন ওনার কোনো অসুবিধা আমি করছি না। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে টুকটাক দুটো কথা বললেন। সব যেন ভীষণ স্বাভাবিক। এই সময়ে যেন ওনার এই বাটিটা ধরাই কাজ ছিল।

খাওয়া হল। মা ঘুমালেন। আমি কৃতজ্ঞতা জানালাম। উনি বললেন, এটা এমন কিছু নয়, সহযাত্রী হিসাবে এটা ওনার কর্তব্য।

ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় এগারো বছর আগের হবে। মা চলে গেছেনই তো দশ বছর হতে চলল প্রায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে আমার মনে পড়ে, ওনার ওই স্থির, শান্তহাতে চিঁড়ের বাটিটা ধরে থাকা।

খুব ছোটো-ছোটো জায়গায় জীবন চলতে ফিরতে এমন অনেক সাহায্য পাই। আপাতত ভাবে ছোটো হলেও, সেই সময়ে ওটাই একমাত্র রাস্তা। চলতে চলতে ফিরে তাকালে মনে হয়, একেই হয় তো করুণা বলে। ক্ষোভের আতসকাঁচ যখন খুব করে ছোটো-ছোটো সমস্যাগুলোকে বড় করে দেখায়, ভয় দেখায়, বিমর্ষ করে দিতে চায় চারদিক, তখন এই করুণা পাওয়া মুহূর্তগুলো মনে আসে। পিছনের দিকে তাকালে দেখি, তরেই তো গিয়েছি কোনো না কোনোভাবে, আটকে তো যাইনি। কেউ না কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়েইছে। অযাচিতভাবে। অপ্রত্যাশিতভাবে। অহেতুক করুণা। পাইনি বলি কি করে, এতটা রাস্তা এত ঝড়জল কি একাই সামলেছি? এতবড় মিথ্যা কথা বললে অকৃতজ্ঞতার সীমা থাকে না যে!