সৌরভ ভট্টাচার্য
21 April 2020
আমার কোনোদিন মনে হয়নি আমি ওকে ভালোবাসি। ভুল বললাম। আমার আগে মনে হত, আমি ভীষণ ভালোবাসি, প্রচণ্ড ভালোবাসি। কিন্তু এখন সেরকম তো কিছু মনে হয় না! কিন্তু একটা দুর্বলতা বোধ কিছুতেই ছেড়ে যায় না। যেদিন থেকে সে আমার জীবনে এসেছে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য সুখ আমি পাইনি, অথবা এমন কিছু উন্নতি বা লাভ আমার জীবনে হয়নি। সে যে কোনো অর্থেই হোক না কেন। ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। তবু আমি ছেড়ে যেতে পারিনি। যতক্ষণ না সে আমায় ছেড়ে গেছে। কিন্তু সেই ছেড়ে যাওয়াটা কোথাও খুব একটা লজ্জার, হেরে যাওয়ার। এতগুলো বছর পরেও আমায় কুরে কুরে খায়। কেন হেরে গেলাম?
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ওর মুখটা মনে পড়ে। ওর সাথে কাটানো ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোর একটা বিষাদময় আকর্ষণ, মনের মধ্যে ভাসা ভাসা সুখ তৈরি করে। আমার পাশে আমার ঘুমন্ত স্ত্রী। ভালোবাসা মানে যার কাছে প্রথম বুঝি। সুখ মানে যার কাছে প্রথম বুঝি। কিন্তু আমার সব সত্তাটা কেন যেন সাড়া দিতে পারে না। আগের সেই মন আর আজকের মনের দেখা হয়, কিন্তু তারা একসাথে ঘর করতে চায় না। আগের মন বড্ড অভিমানী, পরের মন ততটাই অভিমানহীন। সে বারবার মেনে নিতে চায়, স্বীকার করে নিতে চায়। কিন্তু আমার আগের মন কিছুতেই সেসব চায় না। সে একটা বিষাদকে আঁকড়ে বাঁচতে চায়। ছেড়ে যাওয়া মানুষটার সাথে নিজের বর্তমান সুখের তুলনা টানে। তুলনায় সে সব সময় জিতে যায়। সে জয়েও যেন তার সুখ নেই। আমার দিকে আঙুল তোলে। সে মানুষটা সুখী নয় তার নিজের কারণে; আমি সুখী আমার কপালগুনে। আমার পাশের ঘুমন্ত মানুষটার মত একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পাওয়ার জন্য। আমার সুখ আর তার সুখহীন জীবন - দুটো পৃথক ঘটনা। তবু আমি অসুখী।
আমার সাথে ওর, মানে যাকে ছেড়ে এসেছি তার দেখা হয় না তা নয়, মাসে-দু’মাসে দেখা হয়। আমরা দুটো আলাদা শহরে থাকি। যে শহর দুটো পাশাপাশি। আমরা দু’জনেই সফল আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে। কিন্তু তবু কিসের এ ফাঁক? কেন আমার সে মন মরে গেল না? আমি অনেকবার নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেছি, আমি কি ওকে ভালোবাসি? মনের গভীর থেকে উচ্চারিত হয়েছে, না, না। ওকে নিয়ে কি আমি সুখী হতাম? সে ক্ষেত্রেও মনের দ্বিধাহীন উত্তর, না। তবে কেন আমি মেনে নিতে পারছি না। ও কি আমার সাথে থাকলে সুখী হত? না। ও কারো সাথে থাকলেই সুখী হবে না। ও ভালোবাসা মানেই জানে না। ও জানে সুখ মানে টাকা, বিলাসিতা। সে ও পায়নি। সুখের সাথে টাকার হিসাব আজ অবধি কেউ মেলাতে পেরেছে? কেউ না। আমিও ওকে সব দিতে পারতাম না। সে সম্ভব নয়। তাই ও আমার কাছে সুখী হত না। সম্ভব ছিল না।
আমি এখন কম কথা বলি। সবার সাথেই কম কথা বলি। আমার এখন সব সময় ছাইচাপা রাগ। ঘুষঘুষে বিরক্তি। আমার নিজের সাথে কথা হয় না। নিজেকে অসহ্য লাগে। কোথাও যেন আমি ব্যর্থ। কিন্তু কোথায়? বুঝতে পারি না। শুধুমাত্র ওকে নিজের জীবনে পেলাম না বলে? এ তো হাস্যকর যুক্তি। যাকে বোধে বুঝি আমার পক্ষে মঙ্গলের ছিল না, তাকে নিজের হৃদয় দিয়ে মেনে নিতে পারি না কেন? আজকাল আমার স্ত্রী'র উপর আমার অকারণে রাগ হয়। আমাকে নিয়ে আমার স্ত্রী যেমন পরিপূর্ণ, আমি কেন আমার স্ত্রীকে নিয়ে নই? অথচ মানুষ হিসাবে ও অনেক পূর্ণ, অনেক উঁচুস্তরের। আমি নই। আমি কি ওকে ঠকাচ্ছি না? আমি কি নিজেকে ঠকাচ্ছি না? আমার স্ত্রী'র অস্তিত্ব আমার নিজের ক্ষুব্ধতাকে আরো তীক্ষ্ম করে দেয়। আমার মনে হয় ও যেন বিদ্রুপ করছে আমায়। ও যেন সবটা জানে। তবু কিছু বলছে না। ও যেন নিজের মহত্বের মোহে আমায় আরো অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। আমায় বাধ্য করছে আমার অতীতের টানাপোড়েনে নিজের সবটুকু ক্ষয় করে দিতে। ও সাক্ষী থাকছে। নীরব নিশ্চুপ সাক্ষী। ও ভালোবাসে না আমায়। আমার স্ত্রী ভালোবাসা মানে জানে না। ও জানে শুধু সম্পর্ককে কি করে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সচল রাখতে হয়। কিন্তু ভালোবাসা মানে কি সম্পর্ক শুধু?
এখন আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। একটা বিরাট শহরের ছ’তলার উপরের ছাদে। এই বাড়িতে আমার ক্লায়েন্ট ভিজিট ছিল। আমায় এখন অপেক্ষা করতে হবে অনেকক্ষণ। আমার ক্লায়েন্ট রাস্তায় আছে। ফিরতে আরো এক ঘন্টা লাগবে। আমার স্ত্রী চারবার মিসড কল করেছে। ধরিনি। আমার মনের মধ্যে একটা গুহা আছে। একা থাকার গুহা। ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার গুহা একটা। আমি সেই গুহায় ঢুকে বসে আছি। কেউ ডাকতে পারে না আমায় এখন। এ গুহা আমার নিজের বানানো। নিজেকে নিয়ে চুপ করে থাকার মধ্যে একটা নেশা আছে। আমি নেশায় বুঁদ। একা একা বুঁদ। ভালোবাসা কি এখন আর অনুভব করি না। সমস্ত জীবনটা যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আমার জীবনের আমাকে না হলেও চলে। আমার সমস্ত মস্তিষ্কটা একটা অটো প্রোগ্রামিং-এ চলে। আমার শরীর, আমার মন, আমার আবেগ, আমার কাম, আমার দুশ্চিন্তা, আমার স্বপ্ন -- সব আছে। আমার নেই ভালোবাসা। কারণ আমার কোনো কৌতুহল নেই আর। জীবনের সব জানি আমি। সব। সবক’টা বেলুন ফাটানোর পর, অন্য বেলুনগুলো অন্যের জন্য রেখে আমি যেন সরে দাঁড়িয়েছি আমার পুরস্কারটা হাতে নিয়ে। দূর থেকে দেখছি অন্য লোক বেলুন ফাটানোর জন্যে বন্দুকটা তাক করছে, বেলুনওয়ালা তাকে লোভ দেখাচ্ছে নানা পুরস্কারের। সেও মনে মনে ভাবছে সবক’টা বেলুন সে একাই ফাটাবে। সব পুরস্কার সে একাই নিয়ে যাবে। সে জানে না বেলুনওয়ালার ঝুলিতে আছে আরো অজস্র না ফুলানো বেলুন। সে ওপাশ ফিরলেই সে আবার তার সাদা বোর্ডজুড়ে আবার বেলুন ফুলিয়ে রাখবে। আবার নতুন খদ্দের।
আমার ক্লায়েন্ট আসবে না। আমায় এখন এই ছ-তলা থেকে হেঁটে হেঁটে নীচে নামতে হবে। লিফট নেই। আমার আজকের এই বেলুনটা মিস। ধোঁকা। আবার অন্য বেলুন লক্ষ্যে আমার। বাঁচতে হবে। আমার স্ত্রী কেন কোনো বেলুন ফাটায় না?
এখন আমি গাড়িতে। এখনও আমি গুহায়। আমার স্ত্রী চতুর। সে নিজের বেলুনটা ফাটানোর পর আর কোনোদিন এই বোর্ডের সামনে দাঁড়ায়নি। অনেকেই দাঁড়ায় না। অন্যের খেলা দেখে। আমার স্ত্রী নিষ্ঠুর। সে আমার হেরে যাওয়া দেখছে। সে আমার মূর্খামি দেখছে। সে জানে আমি হেরে যাচ্ছি, সে জানে একটা মানুষ কোনোদিন বেলুনওয়ালার সাথে খেলায় জিততে পারে না, তবু সে আমায় কিছু বলে না। সে অহংকারী। নিছক মামুলি অহংকারী। আমি আমার স্ত্রীকে জিতে নিই নি, সে নিজেই আমার কাছে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে, তাই আমার পৌরুষ ক্ষুণ্ণ। আমি হেরে গেছি। আমার ভালোবাসা অতৃপ্ত। আমার সে আগেরজন সে আমায় ঠকিয়েছে। চালে হারিয়েছে। আমি অতৃপ্ত। আমি নিজের ভিতর বিচ্ছিন্ন হেরে যাওয়া মানুষ একটা।
আমার এখন শুধু একটা গুহা আছে। সে গুহায় আমি একা থাকি। বেলুনওয়ালা মাঝে মাঝে আমার গুহার সামনে দিয়ে যায়। আমার গুহায় উঁকি দেয়। আমায় খোঁজে। কারণটা আমি জানি, বেলুনওয়ালা আমায় বেলুন বানাতে চায়। শেষ গুলিটা সে নিজে চালায়। তার শিকার খোঁজে সে। অবশেষে তাদের কাছ থেকে তাদের জিতে যাওয়া পুরস্কার ছিনিয়ে নেয় তাদের একটা গুলিতে হত্যা করে। বেলুনওয়ালার ঝুলিতে অজস্র না ফোলানো বেলুন, অজস্র মৃত মানুষের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া পুরস্কার। আমারটাও নেবে। জানি। যতদিন না আমায় এই গুহায় খুঁজে পায়।