গোঁসাই বলল, তিনশো ষাট ডিগ্রি না ঘুরলে?
মানে?
গোঁসাই বলল, তিনশো ষাট ডিগ্রি না ঘুরে এলে ধাঁধা কাটে না। শান্তি আসে না। দশদিকে দশ ভ্রম হয়। দশদিককে আলাদা আলাদা করে জানলে। ঘুরে নাও, ঘুরে নাও।
বিজয়ার প্রণাম সারতে আসা গোঁসাইয়ের কাছে। গোঁসাই বলল, এসব লৌকিকতা। থাক।
বললাম, অলৌকিক হই তবে?
গোঁসাই হাসল। বলল, অলৌকিক কেন হবে? অধ-লৌকিক হও। মাটি হও। লোক-সমাজ মানুষের কল্পনা। কল্পনার বাইরে এসো। একা হও। তবে সবাইকে পাবে। নইলে কল্পনায় সবাইকে পেতে গেলে দিনের শেষে একা হবে। এই যে এতবড় উৎসব গেল। লোকে লোকারণ্য হল। আজ সে অরণ্য কই? মানুষকে ভিড়ে পাওয়া যায় না। একান্তে পাওয়া যায়। এটা বোঝো।
গোঁসাই গাছের গোড়ায় মাটি দিচ্ছে। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ওদিকে ক'টা ফাঁকা টব আছে। নিয়ে এসো তো। শীতের ফুল আর গ্রীষ্মের ফুল আলাদা বুঝলে। আলাদা যত্ন। আলাদা রঙ।
টব আনলাম। বার ছয় যেতে হল। ফিরে এসে বসলাম। ঘেমেনেয়ে একশা। বললাম, সেই তো বলছিলাম… সব এক না…
গোঁসাই বলল, সব এক নয় তো…. সবকে একের মধ্যে পাওয়া আর সবকে এক করে দেওয়া… এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য বোঝো…. বাগানে নানারকমের গাছ… একে বলে সবকে একের মধ্যে পাওয়া… আর বাগানে শুধু এক জাতের গাছ… বাকি সবকে আগাছা বলা… এটা কোনো কাজের কথা না… বুঝলা?
বললাম, জানি না।
চোখে নানারকম মানুষ দেখো… কানে নানারকম শোনো… কিন্তু ভালোবাসায় সব এক… মানুষকে বেশী কাটাছেঁড়া কোরো না… মাধুর্যটুকু যাবে… ফুলকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করলে যেটা যায় সেটা মাধুর্য… তোমরা দল গড়ে ভাষণ দিয়ে যে সব এক করতে যাও… ওতেও মাধুর্য যায়… আর এই কাটাছেঁড়াতেও যায়… দুই-ই গোলমেলে…
নিজেকেও কাটাছেঁড়া করতে নেই…
না। নেই। যা আছে তাকে দেখতে হয়। জানতে হয়। কাটাছেঁড়া করতে করতে অন্ধকারে ডুবে যায়। শেষে কি পাও? তাই বললাম তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে নিজেকে দেখো.. জগতকে দেখো… মানুষকে দেখো… একঘেয়ে হোয়ো না….
ফিরছি। টোটোতে বসে। চারদিকে ধূ ধূ মাঠ। টোটোওয়ালাকে বললাম, একটু দাঁড়াবে? একটু বেশি দেবখন….
দাঁড়ালো। নামলাম। মাঠে এলাম। চারদিকে তাকালে গোল বাটির মত আকাশটা বসানো মাথার উপর। কিন্তু তিনশো ষাট ডিগ্রি কে ঘুরতে পারে? অতটা সময় পায় মানুষ?
টোটোওয়ালা বলল, শরীর খারাপ লাগছে আপনার?
বললাম, না না। আচ্ছা, আপনার এই খোলা মাঠে দাঁড়াতে কেমন লাগে?
টোটোওয়ালা বলল, ভয় লাগে…. মনে হয় মাথায় আকাশটা ভেঙে পড়বে…
টোটো চলছে।
আমাদের ভয় গোঁসাই। তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরা আমাদের হবে না। আমরা ভয় পাই। হারাবার ভয়। নিজেকে ছাপিয়ে গেলে যদি নিজেই না থাকি?
রাস্তার ধারে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে দেখলাম। ভিড়। লরির সঙ্গে প্রাইভেট কারের। একজন স্পট ডেড।
টোটোওয়ালা নামল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কে ছিল, কারা ছিল, কখন হল, কিভাবে হল…
টোটোওয়ালা মৃত মানুষটার কাছে যেতে চাইছে। ভালো করে দেখতে চাইছে? কি? ভয় লাগছে না কারোর। এত ভিড়। এত কৌতূহল আমাদের মৃত্যু নিয়ে। শরীর নিয়ে।
টোটোওয়ালাকে বললাম, চলো…
সে পকেট থেকে মোবাইল বার করে সেল্ফি তুলল অ্যাক্সিডেন্টের গাড়িটার সঙ্গে। বলল, চলুন।
মানুষ কেন খামোখা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরবে? কয়েক ডিগ্রিতেই যদি এত সুখ গোঁসাই?