দু’জন মানুষ ঠিক করল, তারা ঘর বাঁধবে। যারা নিজেদের ঘরে তো জন্মেছিল, কিন্তু ঘর তাদের নিজেদের ভাবেনি। ছেলেটাকে তার বাড়ির লোক বলেছিল, দূর হ! মেয়েটাকে তার বাড়ির লোকে বলেছিল, দুচ্ছাই!
দূর হ আর দুচ্ছাই ঘর বাঁধলো। ক্রমশ একে অন্যের কাছে যত এলো, গোপনে জাগা দগদগে যত আঘাত চিহ্ন, একে অন্যের অনুভবে ধরা দিল। নীরবে বলল, বুঝি! একে অন্যের আঘাতে প্রলেপ দিল। সেবার আধারে ভালোবাসা ধীরে শুশ্রূষা রূপ নিলো। দূর হ, আর দুচ্ছাই শব্দদুটো কখন যে মিলিয়ে গেল! জানতেই পারল না, একে অন্যের মধ্যে সুখবাসা গড়ে নিলো।
তারা মাটির মধ্যে শিকড় ছড়ালো। শিকড়কে বলল, গভীরে যাও। যে শিকড়ের উপর বিশ্বাস হারাতে বসেছিল, সেই শিকড় পেল জলের ঠিকানা। জল এলো। মুক্ত বাতাস এলো। সূর্যের আলো বসল হাত পা ছড়িয়ে। তারা সবাইকে বলল, এসো।
ক্রমে বাগান হল। বাগানে ফুল ফুটল। ফল ধরল। কিন্তু মনের মধ্যে সুখ কোথাও গিয়ে একটা ঠোক্কর খেলো। দুজনের ছোটোবেলার যে ঘর, যে ঘরে স্মৃতির শিকড় ছিন্নভিন্ন, যে ঘরে তারা ছিল দুচ্ছাই আর দূর হ, সে ঘরের গন্ধ এসে লাগে যখন তখন। হোক কঠিন, থাক অপমান, তবু তো সে ছেলেবেলার ঘর। তবু তো সে আত্মীয়ের বাসা। নাই বা থাক ভালোবাসা! ফিরবে না তাই? নাই বা ডাকল তারা! যাবে না তাই?!
তারা দু’জনেই গেল। তাদের গায়ে তখন সহজ সুখের গন্ধ। আত্মীয় সব নাক সিঁটকে বলল, এত সুখ! এ তো অহংকার! অকৃতজ্ঞতা! হিসাব দাও। ঋণ শোধ করো।
কিসের ঋণ!? নীরবে বলল, দু’জনে দু’জনের চোখের দিকে তাকিয়ে, অনাদরের আবার ঋণ হয় নাকি?
আত্মীয়েরা বলল, কিসের ঋণ? মরতে দিইনি, বাঁচিয়ে রেখেছি! সেই সে ঋণ!
তারা আবার তাকালো নিজেদের চোখের দিকে। ওকে বুঝি বাঁচিয়ে রাখা বলে! আগাছাও তো থাকে বেঁচে! মালীর শত অত্যাচারে! মালী যদি এসে বলে শোধ করো ঋণ! তবে সে কিসের ঋণ! অনাদরের? উপেক্ষার? তাদের সবটুকু সয়ে বেঁচে থাকার অপরাধের? কিসের ঋণ?
কিছু বলল না। শুধু দিল কিছু। আত্মীয়েরা নিল চির অতৃপ্ত, লোভাতুর দুই হাতে।
তারা ফিরে এলো। আসতে আসতে বলল, আবার আসব, সত্যিই আসব, তোমরা যাকে বলো ঋণ! আমরা তাকে বলি, অদেয় ভালোবাসা। তোমাদেরই জন্য ছিল তোলা। সেই কোন যুগ হতে! যা দিতে চেয়েছিলাম, নাও নি উপেক্ষায়। আজ তাই নাও তবে ঋণের মিথ্যা দম্ভ নিয়ে! বিবেকের কাছে হৃদয়কে নীচু করে, ভালোবাসাকে পিষে, দায়ের কপট ছদ্মবেশে!