আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর রাখতে যাবই বা কেন? এ সঙ্গত প্রশ্ন। গাজায় চূড়ান্ত খাদ্যসঙ্কট চলছে। বাচ্চাগুলোর কাঁদার শক্তি অবধি নেই। না খেয়ে মারা যাচ্ছে। আমেরিকা একদিকে শান্তিচুক্তিতে আসতে বলছে, আর অন্যদিকে অস্ত্রের লেনদেন কায়েম রেখেছে। গাজার শিশুদের রক্তের দাগ কি শুধু তবে ইজরায়েলের হাতে?
আমি আদার ব্যাপারী। আমি জাহাজের খবর রাখি না। কিন্তু সে তো ব্যবসা আর লেনদেনের হিসাবে। কিন্তু বাস্তবে? দ্য গার্জিয়ান, ইজরায়েল টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল…. এসব জাহাজের খবর বেচা কাগজগুলো তো এখন এই খালেবিলেও এসে পড়েছে। সেখানে যে অস্ত্রের লেনদেনের হিসাব দেখানো হচ্ছে সেতো চক্ষুচড়কগাছে ওঠার মত। চীন আর রাশিয়া যুদ্ধবিরতিতে সায় দেয়নি। কারণ এক, প্রস্তাব আমেরিকার পক্ষ থেকে এসেছে বলে। দুই, আমেরিকার দ্বিচারিতার জন্য।
কিন্তু এ তো কূটনৈতিক কথা। বেশিক্ষণ মাথায় থাকেও না আমার। কিন্তু বাচ্চাগুলো তো মাথায় থাকছে না শুধু, চিড়ও তো ধরাচ্ছে দৈনন্দিন জীবনে। মানবিকতাবোধের কি কোনো মানচিত্র হয়?
দুর্নীতি কাকে বলে? সেকি শুধুই কোনো সুনীতির বিরুদ্ধে কিছু? সোজা বিষয়, যা অমানবিক তা-ই দুর্নীতি। একটা অবৈজ্ঞানিকভাবে নির্মিত বহুতল হোক, যার আশেপাশের মানুষের জীবন বিপন্ন হয়, একটা কারখানা থেকে নির্গত গ্যাস, কি বর্জ্য হোক যা আশেপাশের মানুষের নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অপরিকল্পিতভাবে ভূনিম্নস্থ জলের অপচয় হোক বোরিং করে, যা কাছের ভবিষ্যৎকেই বিপন্ন করে তুলবে…. সব দুর্নীতি। সব হচ্ছে। বেলাগাম হচ্ছে। যা পরিবেশের বিরুদ্ধে, তাই মানবিকতার বিরুদ্ধে। মানুষ তো পরিবেশ, আবহাওয়া, জল, বাতাস মাটি ছাড়া নয়।
আদার ব্যাপারী আমি। অবশ্যই। কিন্তু জাহাজের থেকে মৃত শিশুদের পচাগন্ধ আমারও নাকে আসছে। পৃথিবীতে দুটোই রাস্তা আছে - বিবেচকের আর অবিবেচকের। বিবেচকের সহিষ্ণুতা আছে। অবিবেচকের লোভ আছে। চাতুরী আছে।
আমি জানি না আমার আদার ব্যবসা আর কতদিন চলবে। মানুষ না পেলে আদা বেচব কাকে?
দুদিন আগে আমার খুব কাছের এক ছাত্রের সন্তান হল। আমি যখন নার্সিংহোমের সিঁড়ি দিয়ে উঠছি তখন নার্স সদ্য তাকে কোলে নিয়ে দেখাতে অপারেশান থিয়েটারের বাইরে এসেছেন। সে প্রবল স্বরে তার আগমন বার্তা জানান দিচ্ছে। আমার আনন্দে চোখে জল এলো। নার্স আমাকে বলছেন, দেখেছেন তো মেয়ে হয়েছে?
না দেখতে পাচ্ছি না তো। চোখ তো ঝাপসা, ওর মুখের উপর আটকে। চোখ তো সরছে না। এই মুহূর্তটা তো সেই আদিম মুহূর্ত যখন মানুষ এক্কেবারে প্রকৃতির তৈরি মানুষ। যার দাবী এই পৃথিবীর মাটি, জল, আলো, বাতাস, খাদ্য সব কিছুর উপর। যার অধিকার আমার ভালোবাসা, আমার স্নেহ, আমার যত্ন, আমার ওকে রক্ষা করার ক্ষমতার উপর।
এই আমি কি শুধুই এই আমি? যে জন্মায় আর যার কোলে মানুষ জন্মায় সে যুগে যুগে একজনই, মানবিকতা। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, মানুষের সন্তানই সবচাইতে দুর্বল হয়ে জন্মায়, তাকে তার মা কোলে তুলে নিয়ে স্তন না দিলে সে বাঁচে না। না খেয়ে মরে যায়।
গাজার বাচ্চাগুলো ঘাস খাচ্ছে জলে ফুটিয়ে। আপনি আমি কি অনুভব করছি এই কথাটা শুনে সে আমার বিবেচ্য নয়। তার বেঁচে থাকার নূন্যতম অধিকার আমার করুণাসাপেক্ষ নয়। আমি “আহা রে, বেচারা” বলার কে? ধিক আমাকে যদি ক্ষণকালের জন্যেও সেটা মনে হয়ে থাকে। বাচ্চাটার বেঁচে থাকার দাবীটা ওর জন্মগত অধিকার। সে দাবীটুকুকে সুরক্ষিত রাখতে পারছি না আমরা। আমরা সুচতুরভাবে অস্ত্রের লেনদেন করছি।
আমি আদার ব্যাপারী। প্যালেস্তাইনের রাফাতে এবার আক্রমণ চালাবে ইজরায়েল। যেখানে হাজার হাজার শরণার্থীরা আছে। আমি ভৌগোলিক অবস্থান, ডেমোগ্রাফিক ইতিহাস জানি না। শুধু জানি আমার আদার দোকানের সামনে দিয়ে যে জাহাজটা যাচ্ছে, সেখানে তেরো হাজার মৃত শিশুর রক্তের দাগ, সেখানে কুড়ি হাজার অনাথ শিশুর মরণাপন্ন জীবন আছে। আমার আদাতে ওদের রক্তের দাগের ছিটে লাগছে। আমি হাত ধোবো পরিষ্কার জল পাচ্ছি না। আমার দুই চোখে কোনো জল নেই। শুষ্ক। আমি ঈশ্বরের না, মানুষের না, কারুর করুণার দিকে তাকিয়ে নেই। আমি অধিকারবোধের কথা বলছি। কোন নীতি, কোন ধর্ম, কোন ব্যবসা, কোন লাভ শিশুকে মারার অস্ত্র বেচে নিজেকে প্রথম বিশ্বের নাগরিক বলে? কোন হাত শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার ছিন্ন করে নিজেকে জয়ী ঘোষণা করে? মানুষের নূন্যতম অধিকার থেকে যদি তাকে বঞ্চিত করো, তবে তোমার নীতি, তোমার ধর্ম, তোমার সভ্যতার পোশাক, আমার কাছে মরীচিকামাত্র। মরীচিকায় তৃষ্ণা মেটে না!