আমি চেয়েছিলাম আমায় কেউ বুঝবে। আমায় কেউ একজন ডেকে বলবে সে আমায় বোঝে। সে আমায় বুঝবে, আমার ভয়, আমার ব্যর্থতা, আমার শঙ্কা, আমার দুর্বলতা। আমায় ঘিরে রাখবে। আমি নিজেকে কাউকে বোঝাতে পারি না। আমার আশেপাশে অন্ধকার ঘোরাফেরা করে। ফিসফিস করে কথা বলে। ওরা জানে আমি দুর্বল। ওরা জানে আমি অনেক কিছু পারি না। আমি ভাতের ফ্যান গালতে পারি না, আমি স্কুটিটা ঠিকমতো ঘোরাতে পারি না, আমি ছাদে কখন জামাকাপড় মেলা তা মনে করে তুলে আনতে পারি না, আমি জ্বর হলে মনে করে ওষুধ খেতে পারি না, আমি নতুন লোকের সাথে কথা বলতে পারি না, আমি ভালোবাসতে পারি না, আমায় কেউ ভালোবাসে না। কেউ না। একমাত্র মা আমায় বুঝত। মা।
কাগজে এই কথাগুলো লেখা ছিল। শুধু এই কথাগুলো। হাতের লেখা কাঁপাকাঁপা। বানান একটাও ভুল নয়। কলেজে পড়াত। বয়েস তেত্রিশ। নাম, বিহঙ্গ। লিঙ্গ, পুরুষ। স্বাস্থ্য আগের ছবিতে স্বাভাবিক, এখন না।
মায়ের মৃত্যু সেরিব্রাল অ্যাটাকে। এক বোন মায়ের মৃত্যুর দুই মাসের মাথায় আত্মহত্যা করে। বিহঙ্গ'র ডাক নাম বান্টি। পাড়ায় কারোর সঙ্গে মিশত না। ভদ্র শান্ত ছেলে বলে সবাই জানে। দু-একবার বিয়ের কথা এগিয়েছিল, কিন্তু নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। কারণগুলো স্পষ্ট নয়। যতটা পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা যায় যে মা, মানে জয়তীদেবী, খুব একটা ছেলেমেয়ের বিয়ে নিয়ে তৎপর ছিলেন না। ছেলেমেয়ে দু'জনেই পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। মেয়ে একটা মাল্টিন্যাশেনাল কোম্পানিতে কাজ করত। জয়তীদেবী হাইস্কুলের টিচার ছিলেন। প্রশান্ত, ওনার স্বামী ছিলেন সরকারি হাস্পাতালের ডাক্তার। রিট্যায়ার করার পর আর চিকিৎসা করেন না।
বাড়িতে ঝগড়াঝাটি, বা অশান্তি বলে কোনোদিন পাড়ায় কেউ শোনেনি কিছু। আত্মীয়স্বজন বলতে কাউকে কেউ আসতে দেখেনি তেমন। পুরো পরিবারটাই পাড়ায় তেমন মিশত না। ওই মৌখিক আলাপটুকুই যা ছিল। প্রতিবার পুজোয় বাইরে কোথাও বেড়াতে চলে যেত সপরিবারে সবাই। মেয়েটা, মানে রণিতা ছুটি না পেলে একাই থাকত, কিন্তু বাইরের কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত না।
চারদিন হয়ে গেল বিহঙ্গ কোনো কথা বলেনি। একটা হোমে রাখা হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতা বলতে সুগার হাই, প্রেশার লো। কিছুটা কিডনির সমস্যা আছে। অনেকদিন ডিহাইড্রেশান থেকে হয়েছে মনে করা হচ্ছে। সারাদিন সে শুধু জানলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। খেতে দিলে খায়। কিছু চায় না। ডাক্তার শর্বাণী অধিকারী দেখছেন। অ্যাকিউট ডিপ্রেশান থেকে উইথড্রয়াল সিম্পটম্পস এসেছে বলে মনে করছেন।
পাঁচদিনের দিন বিহঙ্গ প্রথম কথা বলে, "হ্যাঁ, এখন একটু ভালো লাগছে"।
ছ'দিনের দিন সম্পূর্ণ চুপ। সাতদিনের দিন বলে, ক্যাডবেরি খাবে।
তারপর অল্প অল্প কথা বলত। কিন্তু সবই যেটা দরকার সেটাই, তার বাইরে না। পনেরো দিনের দিন….
- আসলে আমাকে কেউ বোঝে না।
- মা বুঝতেন?
- হ্যাঁ
- বাবা?
(চুপ)
- বুঝতেন না?
(চুপ)
- দিদি?
(চুপ)
- তোমার কোনো বন্ধু নেই?
- না। সবাই স্বার্থপর।
- কি করে জানলে?
- জানি।
- কি করে?
- সবাই নিজেরটা আগে দেখে…
- শুনছি, বলো…
- মা অন্যরকম ছিল... মাকেও ঠকিয়েছে সবাই…
- কারা?
- সবাই... মামারা... কাকুরা…. স্কুলের টিচারেরা…
- এসব কে বলেছেন, মা?
- হুম... এমনকি মায়ের বন্ধুরাও মাকে….
- মায়ের বন্ধুদের তুমি চেনো?....
(চুপ)
আর কথা বলেনি সেদিন। বিকালের দিকে ভীষণ ভায়োলেন্ট হয়ে গিয়েছিল। বারবার নিজের মাথা ঠুকতে যাচ্ছিল দেওয়ালে। কিছু খাচ্ছিল না। কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিল না। ঘুমের ইঞ্জেকশানে ঘুমালো দু'দিন। তার একদিন পরের কথোপকথন।
- তোমার নাম কে রাখে?
- দিদা
- তুমি দেখেছ তাকে?
…..
- তোমার পড়াতে ভালো লাগে?
…….
- তোমার গান শুনতে ভালো লাগে?
……
- বই পড়তে? গল্প করতে?
……
- তোমার কোনো বিশেষ বন্ধু ছিল…
- স্বার্থপর… বললাম না…
- কি নাম?
- সুরঞ্জনা
- এখন যোগাযোগ আছে?
…
- বিয়ে হয়ে গেছে?
….
- তোমার সঙ্গে কলেজে পড়ত?
- ইউনিভার্সিটিতে
আর কথা হল না। হঠাৎ উঠে গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। তবে আগের দিনের মত ভায়োলেন্ট হল না।
- না ম্যাডাম, ওর সঙ্গে আমার রিলেশান বেশিদিন টেকেনি…
- ও কথা বলত?
- খুব কম... কিছু নিয়ে একটা অবসেসড থাকত, আমি অন্য ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে রিয়্যাক্ট করত... তবে প্যাসিভ…
- মানে?
- ধরুন কথা কম বলতো.. বা সারাদিন চুপ.. বা খুব সাধারণ প্রশ্নে ওভাররিয়্যাক্ট..
- আচ্ছা... আর কিছু তোমার মনে হচ্ছে যা আমার জানার দরকার বলে মনে হয় ওর ব্যাপারে….
- আরেকটা বিষয় আছে... জানিনা বলাটা কতটা ফেয়ার হবে…. মে বি ইউ মে থিংক আই অ্যাম নোজি... অর জাজমেন্টাল…
- বলো… এত ভেবো না…
- ওর ফ্যামিলিটা খুব ইউজুয়াল না... অদ্ভুত... মানে আমি ঠিক ভাষায় বোঝাতে পারব না হয় তো... ভীষণ ক্লোজড... সব বিষয়েই সাসপিশাস… ভীষণ উন্নাসিকও মনে হয়েছে আমার…
- কিরকম?
- আমি ওদের বাড়ি একবারই গিয়েছিলাম... ওর মা আমার বাবার স্যালারি পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেছিলেন... ক'টা ঘর…. এইসব... টু পার্সোনাল... বাড়িতে কারোর সাইকোলজিক্যাল কেসের হিস্ট্রি আছে কিনা... ক্যান্সার, সুইসাইড…
- হুম
- ওকি... থাক…
- একটা পার্সোনাল প্রশ্ন করব... ইচ্ছা না হলে বোলো না…
- হুম
- ওর সেক্সুয়াল লাইফ নিয়ে কিছু বলার আছে…
- ভীষণ ক্লোজড... শেকি... জানি না... মানে ওসবে কুঁকড়ে যেত…
- ওকে, লটস অব থ্যাংক্স সুরঞ্জনা... অনেক সাহায্য করলে... আবার লাগলে…
- অলওয়েজ ম্যাডাম... থ্যাংক্স... ও সুস্থ হয়ে উঠলে আমারও ভালো লাগবে….
এর দু'দিন পর...
- দু'দিন ধরে তোমার ঘরে গান চলছে, ভালো লাগছে?
- না
- তুমি কি করতে চাও?
- আমি কোনো আশ্রমে যেতে চাই…
- কোথায়?
- হিমালয়ে
- তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?
- আমি মাকে রোজ দেখতে পাই... ইন ফ্যাক্ট মা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন... মাঝে মাঝে রণিতাও…
- কখন আসেন?
- সকালে। ভোরে।
- কি বলেন?
- কিছু বলেন না। আবার মাঝে মাঝে বলেন।
- কি?
- সাবধানে থাকতে। সবাই আমার ক্ষতি চায়।
- কেন?
- কারণ সবাই চায়।
- দিদি কিছু বলে?
- দিদি বলে আমি ভীতু
- কেন?
- আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি না তাই…
- কিভাবে যাবে?
- দিদির মত করে..
- বাবার কি হবে তবে? বাবা একা হয়ে যাবেন না?
- বাবার কাউকে লাগে না
- কে বলেছে?
- বাবা, মা-ও বলত, আমায় ছেড়ে দাও তোমরা... আমায় হাওড়ায় নামিয়ে দিয়ে এসো….
- কোথায় যাবে?
- ঋষিকেশ…
- কেন?
- আমি মা-কে, দিদিকে দেখতে চাই না
আবার ভীষণ ভায়োলেন্ট হয়ে গেল। এইবারেরটা আগের থেকে বেশি। হাতটা দেওয়ালে মেরে রক্তারক্তি ঘটিয়ে ফেলল। একজন সিস্টার অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। চশমাটা ভাঙল।
এরপর আর কথা বলেনি বিহঙ্গ। দেড় বছর চুপ। খায়, ঘুমায়, শুয়ে থাকে, বসে থাকে। আপনমনে মাঝে মাঝে কথা বলে।
বাড়িতে যাওয়ার দু'মাসের মাথায় গলায় দড়ি দেয়। কোনো সুইসাইড নোট ঘরে পাওয়া যায়নি।