Skip to main content
 
 
এই তৃষা তার তৃষা। ব্যাঙ্কের চেয়ারে বসে থাকা তৃষা নয়। হোক ম্যানেজার, সে যতই সফল ম্যানেজার হোক, আসলে সে এই তৃষাকেই চেনে। কোনো ঈর্ষা নেই। সফল তার নিজের জায়গাতেও সুমন্ত। কিন্তু তৃষার মত করে সে জীবনকে দেখে না। সুমন্ত নিজে কিভাবে জীবনকে দেখে সে নিজেও স্পষ্ট করে জানে না।
      তৃষা ঘুমাচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ। এসিটা ষোলোতে করা। তাও তৃষার শরীরে কোনো চাদর নেই। কোনো আবরণও নেই। সুমন্ত ঘড়ি দেখল, রাত দুটো বেজে দশ। তৃষার দিকে ফিরে আড় হয়ে শুলো। তৃষা তার। একটা জলজ্যান্ত মানুষ তার। যখন তৃষা চাকরি করত না তখন অবশ্য তাকে নিজের বলে বেশি মনে হত, এখন কোথায় যেন একটু খোঁচ, তবু সে তার। তৃষার হাত, কাঁধ, স্তন, নাভি, উরু, পা-দুটো দেখতে দেখতে একটা সুগন্ধী আবেগে ডুবতে শুরু করল যেন সুমন্ত। এই আবেশটাকে উপভোগ করে সুমন্ত। এই উপভোগটা তার একান্ত নিজের। তৃষার সাথে শুধু নয়, এমনকি ঈশ্বরের সাথেও ভাগ করে নিতে নারাজ সুমন্ত। এই পুরো মানুষটা তার একার। শুধুই তার। ইচ্ছা করল তৃষাকে জাগায়, জাগাল না। বিছানা ছেড়ে উঠল। একটা সিগারেট ধরিয়ে বসার ঘরে এসে বসল সুমন্ত। আলো জ্বালল না। সামনের ঝুলবারান্দার দরজাটা খুলে দিল। রাস্তার আলো কিছুটা অন্ধকারকে সরিয়ে বসার ঘরটা আলোকিত করে দিল। এই আলো-আবছায়াটা পছন্দের সুমন্ত'র। এই যেন সে, কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা ধোঁয়াশা। বৃষ্টিটা ধরেছে। ছাদে যেতে ইচ্ছা করছে। যদিও ভূতের ভয় পায় সুমন্ত। তবু এখন ভয় করছে না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে খেয়াল করল তার মনের ভিতরে কিছু একটা বদলে যাচ্ছে। সুখটা কেটে যাচ্ছে। একটা বিষাদের অনুভূতি আসছে, কেন? তৃষার থেকে দূরে যাচ্ছে বলে? সিঁড়িতে দাঁড়ালো সুমন্ত। এই সুখটাকে সে হাতছাড়া করতে চায় না। কেন চলে যাবে? সারাদিনের নানা কাজের চাপে এই অনুভবটুকু যে কোথায় চাপা পড়ে থাকে সে কি জানে? না তো। তবে? কেন কেটে যাবে এত তাড়াতাড়ি? কয়েকটা ধাপ নীচে নামতে নামতে মনে হল আসলে সে নামতে চাইছে না, ছাদেই যেতে চাইছে, ততক্ষণে তার সারা বুক জুড়ে গভীর বিষাদ, মাথার মধ্যে চিন্তাদের উদাসীনতা। উঠতে উঠতে খেয়াল করল বসার ঘরের আলোটায় একটা বিষণ্ণতা। তার সারা সংসার জুড়ে বিষণ্ণতা। সব কিছু যেন বড্ড সাজানো। মিথ্যা।
 
      ছাদে এসে দাঁড়ালো। ছাদে একটা স্লিপার রাখা থাকে, সেটা পায়ে গলিয়ে কার্ণিশের কাছে এসে দাঁড়ালো। সব কিছু মিথ্যা। ভালোবাসা যেন কামের মুখোশ। কাম প্রকৃতির খেলা। সৃষ্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার খেলা। নিরবিচ্ছিন্ন সৃষ্টি সাগরের ঢেউ সে আর তৃষা। আসলে সবটাই বড় বেশি মানবিক করে ফেলেছে মানুষ। মনের মধ্যে রঙীন কুয়াশা, ভালোবাসা। সব কিছু বড্ড বিষণ্ণ, ছেলেখেলা লাগতে লাগল সুমন্ত'র। তার নিজের শরীরটাকেও। যখন তৃষা তাকে ছোঁয়, ভালোবাসে নিজের মধ্যে তার নিজের পুরুষত্ব নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব অনুভব হয়। যেন তার প্রতিটা অঙ্গের সার্থকতা তৃষার ছোঁয়ায়, ভালোবাসায়, চুমুতে, আদরে।
      একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুমন্ত। কতবড় মিথ্যা নিয়ে মানুষের সংসার। হাসপাতালে শুয়ে থাকা শ'য়ে শ'য়ে মানুষের শরীরের ছবি তার মাথায় খেলে গেল। সবাই জীবন্ত। কিন্তু সেই খেলাটা নেই। শরীর-মন একটা লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। অনাদর, কর্তব্য, টাকার হিসাব – মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের কত ডাইমেনশান হয়! সুমন্ত জানে। সবাই জানে। কিন্তু যা কিছু জানা তাকেই কি সামনে এনে দাঁড় করাতে হয়? তবে মানুষ বাঁচে কি করে? মানুষের বাঁচার মূল সুর তৈরি করে দেয় সমাজ। সমাজ মানে মিলিত মানুষের যুগান্তরের অভ্যাস। সে অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে বাঁচে মানুষ। তাকে নিরাপত্তা বলে। সেই নিরাপত্তায় তৃষার শরীর কোথায়? তৃষা কি তার শরীর থেকে আলাদা? না তো। শরীরের বাইরে মানুষের অস্তিত্ব তো কল্পনা। সুখ তো শরীর আর ভাষার। মন বলে কিছু হয় নাকি? ভাষার সুখ ভালোবাসার সুখকে বাড়িয়ে দেয়, লাগাম খুলে বলে, ওড়ো। তার ভাবনায় কল্পনায় ভাষারা ডানা মেলে আকাশের নীলসুখ এনে দেয়, কল্পনার রঙীন তুলি বোনায়, হয়কে নয় করে, নয়কে হয়। মানুষ শরীরের ভাষায় ভালোবাসে। ভাষার শরীরে ভালোবাসে। ভাষা তার কাছে পৃথক অস্তিত্ব। ভাষাতে ভালোবাসার স্বপ্ন, কল্পনা, আনন্দ, উল্লাস, বিরহ।
      সুমন্ত'র তৃষাকে বলা নানা কথা মনে পড়ল। কত কথা। শপিং মলে, ড্রয়িং রুমে, বিছানায়, বাথরুম থেকে চীৎকার করে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, শ্মশানে, হাসপাতালে – কত কথা ছড়িয়ে আছে। আচ্ছা, সব কি সত্যি কথা? সত্যি কথা বলে কিছু কি আদৌ হয়? মানুষ যা বিশ্বাস করতে চায় তাই তার কাছে সত্যি, বাকিটা তো বাস্তব। বাস্তব তো সত্যি নয়, সে তো জগতের ধারাভাষ্য ইন্দ্রিয়ের কাছে। সেখানে মানুষ নিজে কতটুকু? মানুষ নিজে যতটুকু সে তো তার ভাষায়। নিজের সৃষ্ট শব্দের কুহকে।
      একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। বুকের মধ্যে মাঝে মাঝে এত গরম হাওয়া জন্মে যায় কি করে? সুমন্ত জানে না। কেউ জানে না। কতটুকু কথা সত্যি যা যা সে বলেছে তৃষাকে? অনেক সময় তৃষার নাকের পাটা, কোমরের খাঁজ, আঙুলের গড়ন কি বিচ্ছিরি লাগেনি সুমন্ত'র? লেগেছে। আপত্তি লেগেছে নিজের এরকম চিন্তায়। কিন্তু ভাষার সাথে ভাবের যে সম্পর্ক সেখানে কে কবে নাগাল পায়? মানুষের সান্ত্বনা মানুষ বানিয়ে কথা বলতে পারে। নকল শব্দের জাল বুনতে পারে। অভিনয় শিল্পটা সমাজের কেমোফ্লেজ পদ্ধতি। নীতির সাথে ভাবের। নীতিকে পালন না করা যাক, তার অভিনয়টুকু রপ্ত করতে না পারলে মানুষ পাগল বলে, অসামাজিক বলে।
      বিষণ্ণতাটা এখন ক্ষোভ হয়ে ফুটছে সুমন্তের বুকে। কান্না পাচ্ছে। সবটা যেন ভীষণ প্রহসন। এই প্রহসন নিয়ে কতদিন সুস্থ বাঁচে মানুষ? সব চাইতে বড় আয়রনি হল যে এই প্রহসনের স্রষ্টা সে নিজে। মানুষ নিজেই নিজের প্রহসনের জাল বোনে, ক্রমে সেই জালকে সত্যি বলে বিশ্বাস করে, নানা কর্তব্যের সুরায় ভাসতে ভাসতে, উড়তে উড়তে বুঝতে পারে সব চাইতে বড় কর্তব্যটা ফাঁকি দিতেই মানুষের এই নিটোল অভিনয়, মিথ্যাচার। কি সেই সব চাইতে বড় কর্তব্য? না, তাকে ভাষা দেওয়া যায় না। তাকে ভাষায় বাঁধা যায় না। সে একটা ভার্জিন অনুভব। তাকে বাস্তবায়িত করা যায় না – কোনো অমলকান্তি রোদ্দুর হয় না। কোনো ঈশ্বর শেষ পর্যন্ত স্বর্গের ছবিতে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য রাখতে পারে না, সে তখন হাত বাড়িয়ে বলে, আমি মিথ্যা বলিনি, স্বর্গ না, নরক না, আমি আমিই। আমি চিরকাল এমনই – রহস্য।
      ক'টা বাজে? সুমন্ত নীচে নামবে। সে ভিজে চাপ চাপ, কখন বৃষ্টি এসেছে, তাকে ভিজিয়ে গেছে। আচ্ছা কাল যদি হঠাৎ করে সে মারা যায়? তৃষা কতদিন শোকে থাকবে? একটা একত্রিশ বছরের মানুষের শরীর, কতদিন শোকের নাও স্রোতের বিপরীতে বাইতে পারে? সেকি নতুন মাঝিকে নিয়ে উজানে নাও বাইবে না? সেকি পুরোনো নৌকার প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে থাকতে প্রাণপনে সেই নৌকাকে ডুবিয়ে দিয়ে ত্রাণ চাইবে না?
      সুমন্ত জানে সে রূপক ভাষায় কথা বলছে। কঠিন বাস্তবকে ভাষার কোমলতায় আনার চেষ্টা মানুষের প্রাচীন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তৃষার বিছানায় যেন অন্য কেউ। তার কাছেও তৃষার ঘুমন্ত নগ্ন শরীরের প্রতিটা রোমকূপের একই আবেদন। সুমন্ত বসার ঘরে বসল। সোফার উপর শুলো টানটান হয়ে। একটু পরে উঠে তৃষার পাশে গিয়ে শুলো, তৃষাকে জড়িয়ে। তৃষা বাঁ-হাতটা দিয়ে সুমন্তকে জড়িয়ে সুমন্ত'র বুকের কাছে মাথাটা গুঁজে দিল। সুমন্ত'র চোখে জল। মাথার মধ্যে সুখ, বুকের মধ্যে সুখ। ক'টা বাজে? য'টাই বাজুক, সময় মিথ্যা, মৃত্যুর মত অস্তিত্ববান মিথ্যা।