Skip to main content

 অনিকেতবাবু ঝাঁট দিতে দিতে শ্যামাসঙ্গীত গাইছেন। ব্যাঙ্কে ক্লার্ক ছিলেন। বয়েস আটাত্তর। শক্ত-সমর্থ চেহারা। পাড়ার কচি-কাঁচাদের সাথে বেশ বন্ধুত্ব, বলেন, আমি খাঁটি খেয়েছি তাই এ্যাদ্দিন এইভাবে চালিয়ে যাচ্ছি, তোরা পারবি নাকি? যা ভেজাল খাস, পঞ্চাশেই বুড়িয়ে যাবি সব। বলতে বলতে বড় ছেলে দীপকের মুখটা ভেসে ওঠে। টাকিতে দুই ছেলের পাশাপাশি বাড়ি। বড় ছেলে দীপক রাজ্য সরকারের আমলা, ছোটো ছেলে দীপন প্রফেসর। দুজনেরই নিজেদের সংসার। বড় ছেলের এক মেয়ে নবনীতা, ছোটো ছেলের মেয়ে মধুরিমা। টাকিতে বাড়ি। ইছামতীর থেকে হাঁটাপথ তিন মিনিট। পর পর তিনটে বাড়ি। একটা একতলা তার মধ্যে। অনিকেতবাবু আর বৈশালীদেবীর বাড়ি। বৈশালীদেবী অসুস্থ। বাতের ব্যথায় শয্যাশায়ী বললেই চলে একরকম।
        অনিকেতবাবু ঝাঁট দিচ্ছেন বড়ছেলের বাড়ি। আজ রবিবার, সকাল আটটা। ঘুম থেকে ওঠেনি কেউ এখনও। রান্নাঘরের নোংরাগুলো বাইরের ড্রেনে এসে মেশে যেখানে সেখানটা ভাতে আটকে। কি যে করে? ঝাঁট দিয়ে ভাতগুলো এক জায়গায় করে, একটা প্লাস্টিকের হাতলওয়ালা পাত্রে তুলে ড্রেনে ফেলে দিলেন। তারপর কুয়ো থেকে জল তুলে জায়গাটা ধুতে ধুতে মনে মনে বললেন, কি যে করে কাজের লোকগুলো? বড় বউমাকেও বলিহারি যাই, একটু দেখে নিতে হয় তো। বাগানে একটা আমগাছ আছে, অনিকেতবাবুরই লাগানো। ছোটোবড় মিলিয়ে আটটা আম পড়েছে। কাঁচা আম। গতকাল ঝড় হয়েছে না রাতে। একটা একটা করে আম কুয়োতলায় নিয়ে ধুতে বসলেন। গতকাল রাতে বৈশালী ঘুমায়নি ভালো। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল বলছিল। এই তো গেল শুক্রবার কলকাতা থেকে চেক-আপ করে নিয়ে আসা হল। কি যে হচ্ছে? ছোটো আমটায় পোকা লেগেছে, একবার শুঁকে ফেলে দিলেন বাগানের কোণায়। আঁটিটা থেকে আরেকটা গাছ হবে ওখানে? হলে তো পাঁচিলটা ফাটিয়ে দেবে, এরা যা, সেদিকে তো মনই দেবে না। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কোমরে একটা খিঁচ ব্যথা লাগল। আবার বসে খানিক জায়গাটা ডলে ফের উঠে দাঁড়ালেন। আমটা তুলে রাস্তায় ফেলে দিলেন পাঁচিলের ওপারে। 
        এবার ছোটোছেলের বাড়ি। দুই পাঁচিলের দু’দিকেই চারটে চারটে ইট সাজিয়ে উঁচু করা আছে। অনিকেতবাবুর উচ্চতা প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট, ওতেই টপকে যান। লুঙ্গিটা আটকালো। লুঙ্গিটা ছাড়াতে গিয়ে কিসে একটা হাত কাটল। চোখে চশমা নেই, তাই অত খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন না। মাছের কাঁটাটাটা হবে, কাকে মুখে করে নিয়ে এসে পাঁচিলে ফেলে রাখে তো! কাক ঝাড়ুদার পাখি – অনিকেতবাবুর হাসি পেল। ছোটোছেলের উঠোনটা বরাবর পরিষ্কার। ছোটোবউ রত্না এইদিকে খুব নজর। আসলে দুই ছেলেকে আলাদা করে দিয়েছেন অনিকেতবাবুই। সংসারে সবাই মিলে একসাথে বাধ্য না হলে থাকে না – এইটা বুঝেছেন সারা জীবন দিয়ে। স্বাবলম্বী হলেই স্বাধীনতা চাইবেই। কি দরকার, আগে থেকেই জমি কিনে রেখেছিলেন ছেলেদের নামে নামে, পাশাপাশিই। সবার সাথেই সবার সদ্ভাব। কিন্তু সদ্ভাব বড় শৌখিন। আভিজাত্যপূর্ণ শৌখিন। তাই দূরত্ত্বই ভালো। ছোটোছেলের বাড়ি ঝাঁট দিতে দিতে গানের কলিটা হারিয়ে গেছে, আজ দুধ দিতে আসবে না, খাটালেই যেতে হবে। দুধ যে দেয় তার জ্বর। ফোন করেছিল। বৈশালীর কিছু ওষুধও আনতে হবে। আজ চিকেন আনতে হবে। রান্নার মেয়েটা টিভিতে কি একটা নতুন পদ শিখেছে, আজ রাঁধবে। রান্নার মেয়েটা এক প্রকার বৈশালীর কাছেই মানুষ। বিয়েও             দিয়েছে বৈশালীই, কাছাকাছিই, তাই রান্নার কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে।
        অনিকেতবাবু পিছনের দরজা দিয়ে নিজের বাড়ি ঢোকেন, দরজাটা ভেজানোই থাকে। ঘর্মাক্ত শরীরে যখন ঢুকলেন ততক্ষণে বৈশালীদেবী মারা গেছেন। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল রাত থেকেই, বুকে ব্যথাও হচ্ছিল, কিন্তু অনিকেতকে জানাননি। এই বয়সে যা ধকল যায় মানুষটার উপর। এমনকি দুই ছেলের বাড়ির ইলেকট্রিক বিলও গতবছর অবধি দিতে হয়েছে লাইনে দাঁড়িয়ে। এখন কি একটা অনলাইন হয়েছে যে দিতে হয় না। শেষ মুহূর্তটায় বৈশালী প্রাণপণ চাইছিল একবার যদি অনিকেতকে শেষবারের মত দেখতে পায়, দরজার দিকে তাকিয়েই শুয়ে ছিল। সে তখন ঝাঁট দিচ্ছে বড়ছেলের বাড়ি।

        অনিকেত এখন বৃদ্ধাশ্রমে। সে টাকা জমিয়েই রেখেছিল। হয় তার জন্যে, নয় বৈশালীর জন্য। বড় ছেলের বাগানটা বড় নোংরা। ছোটোছেলের বাগানটা ততটা নয়। অনিকেতের বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, সামনের মাসেই।