Skip to main content
 
 
        নীল জামাটার দিকে দু'বার তাকিয়ে দেখল। ভাল্লাগে না। এই জামাটা পরে কেউ রঙ খেলতে যায়? কেন তার আর নতুন কোনো জামা নেই? লোকে বলবে না, বাবাটা অত ভালো চাকরী করে অথচ দেখো ছেলেটা সেই গত বছরের জামা পরেই খেলতে এসেছে।
        বুবাই-এর এবার মাধ্যমিক। আর বেশিদিন নেই। কিন্তু কাল থেকে কিছুতেই জামা পছন্দ হচ্ছে না।
        নীচ থেকে বাচ্চু ডাকল। ওয়াটস অ্যাপে গুচ্ছের মেসেজ। তাদের কম্পাউণ্ডে প্রায় সবাই বাঙালী। কিন্তু দু'দিনই খেলা হয়। কয়েকটা বাড়ি আছে অবাঙালী। সব্বাই নীচে ডাকছে। দুটো জাম্বো বক্স বাজছে। হইহট্টগোলও কানে আসছে।
        বুবাই আবার আলমারি খুলল। কি মনে হল সাদা টি-শার্টটাই বার করল। জিন্সের থ্রি কোয়াটার্সটা এক্কেবারে নতুন, ওটাই পরল। আভা আজকে বিকেলে শাড়ি পরতে পারে বলল। সেও তার সাথেই একই স্কুলে, একই ক্লাসে পড়ে। আভার বাবা ডাক্তার। আভা, গুরমিত, সন্তোষ, পিট্টু, বিশাল, মল্লিকা এদের সবার জন্মই তার মত দক্ষিণ কলকাতায়। উত্তর দিকটা তার কাছে খুব ব্যাক ডেটেড মনে হয়।
 
 
        বুবাই নীচে নামল যখন এগারোটা বেজে গিয়েছে। তার আইফোনটা একটা প্লাস্টিকে জড়িয়ে নিয়েছে। নামতেই আভা এসে তার গালে রঙ মাখিয়ে গেল। আভার আগে আর কেউ রং মাখাক বুবাইকে আভা পছন্দ করে না। আভা বুবাইকে বলল, একটু পরে একটা কথা বলব, তারপর চারদিকটা দেখে বলল, দাঁড়া পিট্টু আসুক। পিট্টু ইলেভেনে পড়ে। পিট্টুর বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে। বছরের প্রায় বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরেই থাকে।
        খেলা চলতে লাগল। একে একে সবাই এসে গেল। হইহট্টগোল হতে হতে বারোটা বাজল। বুবাইয়ের মোবাইলে ফোন এলো। বুবাই ফোনে কথা বলে, কেটে দিয়ে বলল, গাইজ আমাদের টেরেসে যেতে হবে।
        আভা ভুরু কুঁচকে বলল, পিট্টু টেরেসে? 
        বুবাই অবাক হয়ে বলল, তুই কি করে জানলি?
        আভা উত্তর দিল না। বলল, চল।
 
 
        টেরেসে পৌঁছে দেখে পিট্টু দুটো মদের বোতল এনেছে। বিদেশি। বাবার থেকে চুরি করে।
        বুবাই, 'ওয়াও!!' বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পিট্টুকে জড়িয়ে ধরল। গুরমিত কিছুটা নার্ভাস। "মুঝসে নেহি হোগা রে"..., বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুট। সন্তোষ তাকে ডাকতে যাচ্ছিল, আভা বলল, ছেড়ে দে... বাচ্চা।
        গুরমিত তাদের সমবয়েসী যদিও। তবু ভীতু বলে বাচ্চা সে।
        নীচে বড়দের হই হই আওয়াজ আসছে। আভা ঝুঁকে দেখল অন্য কম্পাউণ্ডের লোকজনেরাও এসে গেছে। প্রত্যেক বছর আসে।
        বুবাই বলল, গ্লাস?
        আভা বলল, খোকনদা আনবে সব। খোকন কেয়ারটেকার।
        খোকনদা জানে?! প্রায় আর্তনাদের মত শোনালো বুবাইয়ের গলাটা। লাগারই কথা। আসলে খোকন হল তার মায়ের গ্রামের ছেলে। বয়েস তিরিশের আশেপাশে। দুঃসম্পর্কের কিরকম একটা আত্মীয়ও হয় তার মায়ের। সে নিয়ে আসবে!
 
 
        খানিক পর সত্যিই নিয়ে এলো। কিন্তু তাকে দেখে সুস্থ লাগল না বুবাইয়ের। মুখচোখ ফোলা ফোলা, কিরকম অন্যরকম হাসিটা। পা টলছে। কথা জড়ানো।
বুবাই বলল, খোকন মামা তুই মাল খেয়েছিস?
        খোকন হেসে তার মাথায় চাঁটি মেরে বলল, তুমিও তো খাবে চাঁদু এখন!
মাথায় চাঁটি মারাটা ভালো লাগল না বুবাইয়ের। তবু চেপেই গেল। আভা ব্যাপারটা খেয়াল করল। সে তাড়াতাড়ি বসে পড়ে বলল, সবাই বসে যাও একে একে। কেউ দাঁড়াবে না। টলবে তবে।
        আভা গুনে দেখল সব মিলিয়ে তারা ছ'জন। মেয়ে বলতে একা সেই। ওতে কিছু আনইজি ফিল করে না আভা।
        শুরু হল গ্লাসে ঢালার পর্ব। অনেকেরই প্রথমবার। তবু খেতেই হবে। না খেলে প্রেস্টিজ থাকবে না। আভা আর পিট্টুর কাছে এটা প্রথমবার না।
        দুটো বোতল যখন শেষ হল তখন প্রায় প্রত্যেকেই স্বাভাবিকত্ব হারিয়েছে, এক বুবাই ছাড়া। তার টেস্টটা বিরক্তিকর লাগায়, একটু খেয়ে মুখে দেয়নি আর। আভা কিছু বলেনি। পিট্টু ফিসফিস করে বলেছে, মেয়েছেলের হদ্দ।
        আভা কটমট করে তাকিয়েছে। পিট্টু চেপে গেছে।
 
 
        হঠাৎ কি হল, কেউ কিছু বোঝার আগেই খোকন আভাকে জড়িয়ে ওর ঠোঁটে একটা জোরে চুমু খেল। চুমু খেল বলা ভুল হল, কামড়ে রক্ত বার করে দিল। 
        বুবাই থ। বাকিরা কিছুটা ঘোরের মধ্যে। এমনকি আভাও। সে ঠোঁটে হাত দিয়ে রক্তটা আঁচ করল, আঙুলটা রক্ত লাগা দেখে বলল, সান অফ এ বিচ্... স্কাউন্ড্রেল। ব্যস এর বেশি কিছু না। বুবাই এখনও হতভম্ব। খোকন মামা বোকার মত হাসছে। 
আভার ঠোঁটেও কি হাসির রেখা দেখল বুবাই। সে খোকনের দিকে আবার তাকাল। জিম করা বডি। কালো লম্বা চেহারা। মোটের উপর যথেষ্ট ভালোই দেখতে। বুবাই ভীষণ রোগা অন্যদিকে।
        খোকনমামা আবার আভার দিকে এগোচ্ছে। আভা বলছে, না না....
বুবাই অন্যদের দিকে তাকালো। সবাই টাল খেয়ে পড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। খোকন আভার দিকে এগোচ্ছে। আভার চোখেমুখে একটা অদ্ভুত লজ্জা। বুবাইয়ের মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। কানের থেকে গরম হাওয়া বেরোচ্ছে। খোকন আভাকে জড়িয়ে ছাদেই শুয়ে পড়েছে। তার একটা হাত আভার টপের নীচে।
        বুবাই চারদিক তাকালো। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। বুকের ভিতরটায় ধকধক আওয়াজ প্রায় গলার কাছে এসে গেছে। জিভটা শুকনো। আভা কিছুটা আদুরে সুরেই বলছে যেন, না... না... যাও... এখানে না... এখন না....
        বুবাই একটা খালি মদের বোতল নিয়ে খোকনের মাথার পিছনে নিজের সব শক্তিটুকু দিয়ে মারল। তারপর মারতেই থাকল... মারতেই থাকল... মারতেই থাকল... ছাদের মেঝেটা লাল হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছে... কিন্তু চোখের সামনে কিছু যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না।
 
 
        পুলিশ ভ্যানে উঠেও কিছু বুঝতে পারছিল না বুবাই। তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। খুব ঘুম পাচ্ছে। তার গায়ের সাদা জামাটায় লাল রঙের ছিটে। রঙের না রক্তের বুঝতে পারছে না। বাবা মায়ের কথাটা মাথায় আসছে না, ওরা আবার বিজি হয়ে যাবে তাকে থানায় পৌঁছিয়েই, যেমন গেলবার পক্সের সময় হয়েছিল। সে তো মিনতি মাসির কাছেই থাকত। মিনতি মাসি গলায় দড়ি দিয়েছে দু'মাস আগে। মিনতি মাসির কাছেই সে বড় হয়েছে। জ্বর হলে সে কি খেতে চায় মিনতি মাসিই জানত.... মা না।
        তার স্কুলটা পেরিয়ে যাচ্ছে। বন্ধ। পিছনে পিছনে তার বাবার গাড়িটা আসছে। মা বাবার পাশে। মায়ের গাড়িটা বার করল না আজ? অবশ্য দুটো গাড়ির তেল পুড়িয়ে কি হবে? বোর্ডের এক্সামের কথা মনে হল একবার। কয়েকজন মিসেদের কথা মনে পড়ল... অরুণাংশু ফার্স্ট হয়ে যাবে এবার বোর্ডে... প্রি বোর্ডে ও সেকেণ্ড ছিল... তার আবার ঘুম পাচ্ছে....