সৌরভ ভট্টাচার্য
24 June 2018
অবশেষে বর্ষা এলো। আজ থেকে যাও। আমায় একবার আজ ছাদে নিয়ে যাও। সিঁড়ির ঘরের দরজার সামনে আমার হুইলচেয়ারটা রেখো। হাত বাড়িয়ে সিঁড়ির ঘরের কার্ণিশ চোঁয়ানো জল এসে পড়ুক আমার হাতের তালুতে। হাতের তালুর ভাঁজে ভাঁজে বৃষ্টির জলের নদী।
আমি জানি আকাশটায় আজ কাল পরশু মেঘ থাকবে। আমি জানি সারা সপ্তাহ মেঘ থাকবে। আমি জানি সারা মাস মেঘ থাকবে, যতদিন না কাশ এসে বলে, এবার তোমার ছুটি। মিনতি বৌদি আবার চীৎকার শুরু করবে কাল থেকে, “কাচা জামাকাপড়গুলো কোথায় মেলব? আমার মাথায়?... কি গন্ধ হয়েছে... একটাও শুকালো না... কবে যে সুয্যের মুখ দেখব?”... সেই মিনতি বৌদিই দুপুরবেলা “শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা” গাইবে... ছায়া ঘনাইছে বনে বনে... গাইতে গাইতে কাঁদবে... তুমি রাতে কান পাতলে শুনবে আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার..... আসলে সব মানুষই তো অভিসারে যেতে চায়... ক'জন যেতে পারে বলো?... আমার সন্দেহ হয় রাধাও কি পেরেছিল... একটা মেয়ে এত ভালোবাসা সারাজীবন কোনো পুরুষের পায়?... রাধা পেয়েছিল?... ওই মেঘ সেই পুরুষ... রাধা কি তবে ওই সবুজ মাঠ?... এই কি অভিসার!...
দিনের আলো কমলে আমি বুঝতে পারি। শাঁখের আওয়াজে বুঝতে পারি। বর্ষার এক নাগাড়ে ধারাপাতের শব্দ শুনতে শুনতে যখন কানটা সয়ে যায়, আচমকা এই শাঁখের আওয়াজ আবার মনে করিয়ে দেয় বাইরেটা এখনও ভিজছে। কাপড় না শোকানোর শোক মেঘ জানতে চায় না। মেঘ জানতে চায়, কি যেন তুমি ওকে বলতে চেয়েছিলে গত বর্ষায়? পারোনি। হয় সময় হয়নি, নয় ভুলে গিয়েছিলে? সেই কথাটা সে আবার জানবে বলেই যেন এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। শুধু তোমার জন্য। মিথ্যা কল্পনা, সুখের কল্পনা। সুখের থেকে বড় মিথ্যা সংসারে আর দুটো কি আছে বলো?
আমায় এবার ছাদ থেকে নীচে নামিয়ে এনো। কোনো গান নাই বা চলুক ঘরে অসুবিধা নেই। তুমি শুধু অভাবের কথা আর অভিযোগের কথা বোলো না। বর্ষার সন্ধ্যায় আমার আরো বিষন্ন লাগে। নেই তো সংসারে কত কিছু গো, আমিও তো পুরোটা থেকেও নেই, তুমিও তো নেই। কোনো মানুষই মৃত্যুর প্রাক্কাল অবধি পুরোটা থাকে না। পুরোটা জন্মায় না। আমিও না, তুমিও না। আমাদের সেই অজাত, অপ্রকাশিত সত্তার আশেপাশে মেঘ জমে। একটা দুটো কবিতার অঙ্কুর হয়। সব অঙ্কুর শেষ অবধি বাঁচে কই? তাই আজ সন্ধ্যায় তুমি আর অভাবের কথা, অভিযোগের কথা বোলো না। অভিযোগ তো সবার আছে। পাতা হাতেই অভিযোগ, হাতটা পেতো না আজ। বরং আজ হাতদুটো নিজের বুকের উপর রাখো। দেখো কত কাছাকাছি বাঁচা যেত, বর্ষার জলের বিন্দুর সাথে যেভাবে মাটি মিশে যাচ্ছে, সেভাবেই মিশে থাকা যেত। গেল না। আর কিছু না হোক, নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়েও মিশে থাকা গেল না। কেন গেল না কেউ জানে না। সাধু বলে মায়া; সংসারী বলে কর্তব্য; বিজ্ঞানী বলে বাইরের ডাকে সাড়া দেওয়া, সেই তো জীবন। এরা সবাই মিথ্যা কথা বলে, আমি তো জানি আমার মধ্যে ঈশ্বর থাকুক না থাকুক, নদী দিয়ে ঘেরা একটা উপত্যকা আছে। সেই উপত্যকার থেকে দূত আসে বাইরের জগতে এর ওর মতন করে সেজে। তারা কাঁদায়, হাসায়, স্বপ্ন দেখায়। তারপর সাজটা খসে যায়, দূত ফিরে যায়। কেউ সাজের জন্য হাত পা ছুঁড়ে কাঁদে, কেউ চুপিচুপি সেই দূতের পিছু পিছু উপত্যকায় এসে পৌঁছায়। বাইরে সব হারিয়ে নিজের মধ্যে একটা মানে খুঁজে পায়। যে হয়ে সন্তুষ্ট না হয়, সে পেয়ে কি আর সন্তুষ্ট থাকে গো? তুমি আজ পাওয়া, না পাওয়ার কথা বোলো না। অভাবী সেজো না, অভাব থাকবে না।
রাত নামুক। দেখো, এই ব্যাঙের ডাকের মধ্যে একটা আত্মগর্ব আছে। লোকে বলে যৌনতার ডাক। তবু সে যৌনতাতে তো তার আস্থা আছে বলো? আমি যেদিন অন্ধ হলাম, সেদিন মনে হল আমার সব কিছু বুঝি হারালো। আসলে আমরা সব কিছু মানে এত অল্প কিছু বুঝি! যাই হারাই ভাবি সব হারালো। আচ্ছা বলো, সব কি কেউ হারাতে পারে? সব শেষে নিজে যে সে বাকিই থেকেই যায়। তুমি বলবে, এতো দর্শন! আমি বলব হ্যাঁ তো, দর্শন, বাইরের দর্শনটা হারিয়ে এই দর্শনের আনন্দ পেয়েছি। যা বহুমূল্য ভেবেছিলাম, তা হারাবার পর তার মূল্য বুঝলাম, আস্থা ফিরে পেলাম - হারিয়ে অর্জিত আস্থা।
আমি জানি তুমি সকালবেলায় চলে গেছ। আমায় না বলেই গেছ। কারণ আমার অনুরোধ না রাখার যন্ত্রণার চেয়ে তোমার না থাকতে চাওয়ার অপরাধবোধটা প্রবল। তাই হয়, তুমি অহংকারী। অহংকারীর সব চাইতে বড় যন্ত্রণা তার ঘর শূন্য থাকার না, তার নিজের বাইরে বেরোনোর অক্ষমতায়। আজ সবার কাছে তোমার দাবী। একদিন তোমার ছিল স্বপ্ন। সেদিন আমি ছিলাম। স্বপ্ন হল বাসনা। সেদিনও আমি ছিলাম, আগের মত নয়, তবু ছিলাম। তোমার বাসনারা হল দাবী। সেদিন থেকে তুমি রণক্ষেত্রে একা। ক্লান্ত হবে যেদিন শূন্যহাতে এসো। আমার ঘরের দরজা দু'দিকেই খোলে। আমি অপেক্ষায় থাকব, শ্রাবণের মত। এখন আমি অভিসারে যাব। একা। বৃষ্টির আওয়াজে নূপুর বেজেছে, শুনতে পাচ্ছি।