Skip to main content
 
 
       হয় না, সবার যেমন হয়। তবে সবাই যেমন বুঝতে পারে না। না না, সবাই না, অনেকে বুঝতেও পারে। তারা খুব কম। এ মানুষটা কমের মধ্যে নয়, বেশির মধ্যেই। এ বুঝতে পারে যা বলছে তা ঠিক বলছে না, কিন্তু ঠিকটা যে কি তাও বুঝতে পারছে না। আর বুঝবেই বা কি করে? বুঝতে গেলে ভাবতে হয়। ভাবার সময় কই তার? 
       একদিন ভোরে লোকটার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে অভিধানটা নিয়ে বসল। চলন্তিকা। কটা শব্দ সে সারাজীবন ব্যবহার করেছে দেখতে লাগল। গুনতে গুনতে আবার ঘুম পেয়ে গেল। আবার প্রথম থেকে গুনে দেখল। একটা শব্দের মধ্যেও তার মনের কথাটা খুঁজে পেল না। মনশব্দটাও ভালো লাগে না আজকাল। তার ঘরের রঙচটা দেওয়ালের মত মনটাও যেন বড্ড একঘেয়ে। পাশবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমালো না। কয়েকটা শব্দ নিয়ে মাথার মধ্যে নাড়াচাড়া করতে লাগল বিশ্বাস, ভালোবাসা, ক্ষমা, ঈশ্বর, আলো, আকাশ, ছায়া, জল, তেষ্টা ... শব্দগুলো মনের মধ্যে বাজে তুবড়ির মত ভুস করে জ্বলেই নিভে নিভে যেতে লাগল। খারাপ, খুব খারাপ। এরকম কেন হচ্ছে? শব্দের কি বয়েস হয়? এক্সপায়ারি ডেট থাকে? 
       ভগবানকে ডাকল। অন্যদিনের মত আজও এলো না। না আসুক। গান গাইল। সুর লাগল, মন লাগল না। ইতিমধ্যে প্রাকৃতিক কর্ম সারা হল। গাছে জল দেওয়া হল। চা খাওয়া হল। খবরের কাগজের প্রথমপাতা থেকে শেষ পাতায় চোখ বোলানো হল। পাড়ার নেড়িটাকে আদর করা হল। স্নান করতে করতে কয়েকটা কাঁচা কাঁচা খুব খারাপ কথা মনে করা হল। কিন্তু কিছুতেই মনের শব্দটা খুঁজেই পাচ্ছে না। 
       অফিস যেতে ট্রেনে একচোট ঘুম হয়ে গেল। আজ কাউকে উঠে জায়গা দিল না। ভাবল কয়েকটা খারাপ কথা শুনবে, কারণ ইচ্ছা করে আজ প্রতিদিনের বগিটায় ওঠেনি, এই বগিতে সবাই অচেনা। কিন্তু কেউ কিচ্ছু বলল না। সেদিন অফিসেও ঘুমিয়ে পড়ল, একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখল, সে একটা অভিধান হয়ে গেছে, তার সারা শরীরের অনেক শব্দ, কিন্তু কোনো শব্দের সাথে তার হৃদয়ের যোগ নেই, তাই হৃদয়টাও নেই। বিচ্ছিরি স্বপ্ন। ঘুম থেকে উঠে চোখের কোণের পিচুটি ধুতে ধুতে পিচুটি শব্দটা নিয়েও ভাবল খুব খারাপ শব্দ। তবে কোন শব্দটা খুঁজছে সে? 
       ধড়াম করে আওয়াজ, চমকে ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠল। রাত কটা হবে? মনে হল দুটো বেজে গেছে। প্রচণ্ড জোরে মেঘ ডেকে উঠল, সাথে তুমুল ঝড়। মশারি থেকে উঠতেই অভিধানে পা পড়ে স্লিপ খাচ্ছিল আরেকটু হলে, খাটের ধারটা ধরে সামলে নিল। শুতে যাওয়ার আগে মেঝেতে বসে পড়তে পড়তেই ঘুম চলে আসে, আলো নিভিয়ে সটান বিছানায়। রান্নাঘরের জানলাটা ধড়াম করে পড়ল। রান্নাঘরে ঢুকে আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখল কারেন্ট নেই। যা হোক, সবই চেনা। চেনাশব্দটা ভালো, তবে মনের মত নয়। জানলা, ঝড়, অন্ধকার কোনো শব্দটাই নয়। হঠাৎ পায়ে কি একটা ঠাণ্ডা ঠেকল, সাপ! একটা জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠতে জানলা দিয়ে ঠিকরে আলো এলো ঘরে। একটা সাপ তার পায়ের থেকে ঠিক দু ইঞ্চি দূরে। বেশ বড়। লোকটার সারা শরীর অবশ। নড়বার শক্তি নেই। হাতে টর্চ নেই। মোবাইল বিছানায়, সম্ভবত চার্জও নেই। মারা যাবে? দুদিন পর বডি পাবে? সাপটা কি মায়োটক্সিক, নিউরোটক্সিক? মুদির দোকানে টাকাটা দেওয়া হয়নি, ফ্রিজে নতুন দুটো মদের বোতল, আঙুলে ভোটের দাগ না পড়েই পুড়ে যাবে? 
       হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠল মানুষটা। ধুম করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা টেনে ছিটকিনি দিয়ে খাটে উঠতে আবার অভিধানে সটান লাথি, লাফ দিয়ে খাটে। বুকটা এতজোর ধড়াস ধড়াস করছে মনে হচ্ছে হার্টফেল হবে। 
       সকালে উঠে পাড়ার দুটো ছেলেকে ডেকে রান্নাঘর খুলল। হাতে কার্বলিক আর লাঠি। সাপটা নেই। আশ্চর্য সেদিন থেকে আর অভিধানটাও পাওয়া গেল না। সব শব্দের মানে এখন যেন একটাই বাঁচা। শব্দটা পুরোনো, কিন্তু মানেটা নতুন। কিন্তু অভিধানটা?