বাঙালি হুজুগে জাত। জন্মাবধি শুনে আসছি। আমার জন্মানোর বহুযুগ আগে যারা বাঙালি হয়ে জন্মেছিলেন তারাও একই কথা লিখে গেছেন। অর্থাৎ এই নিয়ে মতান্তর থাকার কথা নয়।
হুজুগের মাত্রাটা আরেকটু চড়িয়ে বললে, বাঙালি আবেগপ্রবণ জাত। এ কথাও বাঙালি সৃষ্টি করার সময় বিধাতা বিশেষ করে মাথায় রেখেছিলেন বলেই শুনেছি।
এখন এই হুজুগ আর আবেগের যে প্রবল মিশ্রণ তার ফলে যে মানুষ নারী-পুরুষ জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় কাল সারা বিশ্ব দেখল। যারা আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেলগুলো দেখেছেন তারা জানেন ভারতে অনেক জায়গায় গতকাল ভোট হলেও আমরাই ছিলাম শিরোনামে। এ এক গর্বের বিষয়। আমি অনেকদিন ধরে শুনে আসছি নারী-পুরুষের এই বিভাজন রেখাটা তুলে দাও, তুলে দাও... ট্রেনে বাসে 'লেডিস' এর জন্য বিশেষ ব্যবস্থাগুলো উঠিয়ে দাও... কোনো ভেদাভেদ নেই নারীপুরুষে...... গতকাল সত্যিই দেখলাম আসলেই কোনো ভেদাভেদ নেই।
তবে চড়টা দেখতে একটু অস্বস্তি লাগছিল। এভাবে সিনেমায় দেখেছি। মায় 'থাপ্পড়' বলে অতবড় একটা সিনেমাও হলে বসে বসে দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে খবরের চ্যানেলে এইভাবে চড়টা দেখতে একটু যেন শিউরেই উঠলাম। আরেকজনের মাথায় লাঠির বাড়ি পড়েছে দেখলাম। ভয় লাগল।
আসলে নতুন করে হতাশ হচ্ছি না আর। হতাশ হওয়ার মাত্রাটা বাড়ছে এই যা। ভাইরাস লোড কথাটা যেমন খুব শুনছি, তেমনই হতাশার লোড বাড়ছে। কিন্তু মনে মনে এ সংশয়ও জাগছে, আচ্ছা মারটি যদি পুরুষের গাল মাথায় পড়ত? এ চিন্তা কেন এল? আসলে ওই যে কদিন আগে শুনলাম না, "মহিলা বলে সেফগার্ড নেবেন না"। এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির দিকে এগোচ্ছি কিনা তো জানি না আমরা সবাই। আমরা তো আসলে সবাই 'নাগরিক', তাই আমি প্রচণ্ড কনফিউশানে ভুগছি, আমি দুজন মহিলা হেনস্থা হয়েছেন বলে যে অতিরিক্ত লজ্জা, অস্বস্তি, যন্ত্রণা অনুভব করছি, সেটা তবে আজকের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে তো বেমানান! 'রাজনীতি করতে আসবে আবার মার-চড় খাবে না? মার চড় খেলেই মহিলা হয়ে যাবেন'..... যদি এই কথা কেউ বলে বসেন, তবে আমার কি উত্তর হবে?
আমার কোনো উত্তরই হবে না। এখন যুক্তির দরকার নেই। এখন জোরের রাজ্য। পণ দিতে পারেনি বলে একজন মহিলাকে উলঙ্গ করে সবার সামনেই অত্যাচার করা হয়েছে না উড়িষ্যায়? তবে? ওরা করেছে অন্ধবিশ্বাসে, সামাজিক কুসংস্কারের বশে বা লোভে, আমরা করছি আমাদের চূড়ান্ত আবেগ আর হুজুগের বশে। আরেকটা ভিডিও তো দেখানো হচ্ছিল না একজন মহিলার রাস্তা আটকে একজন শাসানি দিচ্ছিল, ভোট দিতে গেলে তার এমন খারাপ অবস্থা করে দেবে.....
ভালো। লজ্জাবোধ, শালীনতাবোধ, সংযম উঠে যখন যাচ্ছে, তখন আর সে নিয়ে হাহুতাশ করে লাভ কি। শংকরাচার্য বলেন বলটাকে প্রথম সিঁডিতে আটকাতে না পারলে পরের সিঁড়িতে আর আটকানো যায় না। অশালীনতা, অসংযম এর বল তো অনেকদিন আগেই উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের হাত থেকে পড়ে গেছে। এগুলো তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ঈশ্বরের ভয়ে কিম্বা বিবেকের অনুশাসনে চলা মানুষের চরিত্রের আশা করার দিন নেই আর। অবশিষ্ট থাকে আইনের ভয়। সেটুকুও যখন প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন বুঝতে হবে এক ভয়াবহ সুনামির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। শুধু দিনগোনার অপেক্ষা। আসলে ওই যে কথায় আছে না, চরিত্র নষ্ট তো সমূলে সবই নষ্ট! আমাদের চরিত্র কোথায়? আমাদের তো আবেগ আর হুজুগ! মারলেই না বাঁশ, মারলেই বা চড়! এ তো সবে শুরু।