Skip to main content

(কঠোরভাবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য)

 

-----
আবার গায়েব! এবার একটু ঘাবড়েই গেল অঞ্জন। উপরের তলার একটা ছবির ফ্রেমও বাদ যায় নি, একটাতেও ছবি নেই! ছবির জায়গাগুলো ফাঁকা। বাকি সব ঠিকঠাক। অঞ্জন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাতে ফ্রেমগুলো নিয়ে দেখল। নাঃ, সব এক অবস্থা।
      সুন্দরবনের এই বাগান বাড়িটা অঞ্জনের ঠাকুরদার। তারা এখন সবাই আসামে চলে গেছে। অঞ্জনও সেখানেই চাকরী করে। তার ২৭ বছর বয়েস, বেশ সুঠাম চেহারা। এই বাগান বাড়িটা বিক্রির উদ্দেশ্যে তার আসা। এই প্রথম। বাবা সাথে আসতে চেয়েছিলেন যদিও। সে আপত্তি জানিয়েছে। এতটা রাস্তা। তা ছাড়া ওনার শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। এই জঙ্গলে অসুস্থ হলে কি হবে?
      দু'দিন হল সে এসেছে। প্রথম রাতটা কিছু হয় নি। দ্বিতীয় রাতে নীচের ঘরে একই ঘটনা ঘটে। ঘুম থেকে উঠে দেখে তার সামনের ছবির ফ্রেমে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিটা নেই। ফ্রেম, ছবির চারপাশের বর্ডার সব ঠিক আছে। মাঝখান থেকে ছবিটা হাওয়া! রতনদা আসার পর তাকে বলবে বলবে করেও কিছু বলেনি অঞ্জন। রতনদার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। একটু দূরেই গ্রামে বাড়ি। সেই এই বাড়িটার দেখাশোনা করে। তবে অঞ্জন লক্ষ করেছে, কোনো কারণে রতনদা এই বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেলে আর মাড়াতে চায় না। এমনকি তাকেও বলেছিল সে যেন রতনদার বাড়ি গিয়েই রাতটা অন্তত থাকে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে, মুখ ফ্যাকাসে করে বলেছিল, "এ বাড়িতে রাত্তিরে থাকা ঠিক না, পিশাচ বাস করে।"
       অঞ্জনের হাসি পেয়েছিল। সত্যিই গ্রামের লোকের ধ্যান-ধারণা আর পাল্টানোর না।
      যা হোক। তবে আজ একটু অবাক হল বেশি। দোতলার ঘরে বেশ কিছু মনীষীদের ছবিও ছিল। স্বামীজী, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ। তার সাথে কিছু দেব-দেবীর ছবি। সব ক'টার এক অবস্থা।
রতনদা নিজে থেকে খেয়াল করলে সে কিছু বলত। কিন্তু রতনদার চোখ এড়িয়ে গেছে। সে অবশ্য পালাতে পারলেই বাঁচে, এমনভাবেই এ বাড়িতে ঢোকে। সে যা হোক অঞ্জন আজ কলকাতায় যাবে, বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে। ফিরতে রাত হবে।



------
অঞ্জন যখন ফিরল, তখন রাত ১২.৩০। বাইরে থেকেই খেয়ে এসেছিল। রতনদাকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছিল আগে থেকেই।
      দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই মনে হল কিছু একটা উপরে উঠে গেল। আলো জ্বালল। না, কিছু না তো।
      বাড়িটা খুব বড় না হলেও খুব ছোটোও না। নীচে তিনটে বড় শোয়ার ঘর। উপরেও তাই। নীচে ওয়েস্টার্ন আর উপরে ইন্ডিয়ান স্টাইল বাথরুম দুটো। সিঁড়িটা কাঠের।
      অঞ্জন খেয়াল করল ঘরের গন্ধটা কেমন অচেনা অচেনা। কিসের মনে করতে পারল না। তবে খুব উগ্র। একটা টর্চ নিয়ে বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখতে বেরোলো। গন্ধটা কি বাইরে থেকে আসছে? মাটিটা ভিজে ভিজে। সেপ্টেম্বর মাস। শিশির পড়েছে এরই মধ্যে? একটা জায়গায় একটু থমকে দাঁড়াল। ঘাসে রক্তের দাগ। অঞ্জন টর্চটা খুব কাছে নিয়ে গিয়ে দেখল। বেশ টাটকা রক্ত। এমন সময় একটা 'খট্' আওয়াজ শুনে উপরে তাকালো। মনে হল, উপরে তার শোয়ার ঘরের জানলায় কেউ দাঁড়িয়ে তারই দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। হালকা আবছায়া মতন লাগছে।
      অঞ্জনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিম স্রোত নেমে গেল। কে হতে পারে? সে বুঝছে তার বগল ঘামছে, পাটা হালকা কাঁপছে। কিছুটা সামলে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। টর্চটা জোর করে কাঁপা হাতে জানলায় ফেলল। নাঃ কিছু না।
      ঘরে এল। দরজায় তালা দিল। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তার মনে হল তার পিছন পিছন কেউ যেন উঠছে। সে থমকে পিছন ফিরল। না তো। নীচটায় একটা জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বালানো, তাতে মোটামুটি ভালই দেখা যাচ্ছে। কিছুই নেই। সে ফিরে উঠতে যাবে, হঠাৎ মনে হল দরজার খিলটা নামানো দেখল না। হ্যাঁ তাই। খুব আশ্চর্য লাগছে। একটু অস্বস্তিও হচ্ছে। বুকের ভিতরের আওয়াজটা যেন দেওয়ালগুলো অবধি শুনতে পাচ্ছে। খিলটা আটকে আবার ফিরল। আচমকা মনে হল কে যেন তার ঘাড় ছুঁলো। ঠান্ডা স্পর্শ! এতটা ঠান্ডা সে চমকে, 'আঃ' বলে উঠল অস্ফুটেই। কিন্তু কই, কেউই তো নেই চারপাশে! সে কি ভয় পেয়ে যাচ্ছে অকারণেই? হঠাৎ বাইরে ভীষণ কুকুর ডাকতে লাগল। কাঁপা কাঁপা পায়ে জানলার কাছে গিয়ে দেখে সামনের মাঠে ছোটো ছোটো অনেক বাচ্চা। উলঙ্গ, ফ্যাকাসে, মুখগুলো স্পষ্ট না, তবু অদ্ভুত। মাথাগুলো যেন থ্যাঁতলান। ঠিক দেখছে? অঞ্জন বুঝতে পারল না। কিছু বোঝার আগেই সব হাওয়া। রাতের হাল্কা আলো। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। তার কেমন যেন মনে হতে লাগল সে স্বপ্নে আছে, কিসের একটা ঘোরে।



------
দোতালায় উঠতে যাবে, কেউ দাঁড়িয়ে না? না, কে না তো, কারা? 
      অনেকগুলো আবছায়া মূর্তি। অঞ্জনের দিকে এগিয়ে আসছে। ওই তো, সিঁড়ি দিয়ে নামছে। সার দিয়ে। অঞ্জনের পায়ে মনে হল কে তালা আটকে চাবি হারিয়ে ফেলেছে। সে নড়তে চাইছে, পালাতে চাইছে, চীৎকার করতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। একটা বোঁটকা, পচা গন্ধ নাকে আসতে শুরু করেছে। আবছায়া মূর্তিগুলো তার কাছাকাছি এসে গেছে, তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। সে বলল, "কে আপনারা? কি জন্য এসেছেন? কি চাই?"
      কিছু শব্দ বেরোলো মুখ ফুটে, কিছু বেরোলো না। একটা শব্দ শুনল হিসহিসে। মনে হল ওরা বলল, আয় আয় আয়।
      হঠাৎই সব মিলিয়ে গেল। অঞ্জনের সারা গা ঘেমে স্নান। খুব বমি বমি পাচ্ছে। সে জামা খুলে মেঝেতেই বসে পড়ল। একটা বড় ভয় পেলে মানুষ আরেকটা ভয় পেতে পারে না। তার যেন ভয় পাওয়ার শক্তিও আর নেই।
     ঘড়িতে দেখল, দুটো পাঁচ বাজে। উঠল। ফের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল। টর্চটা নিতে ভুলল। বেশ খানিকক্ষণ ওঠার পর তার মনে হল সিঁড়িটা যেন শেষ হচ্ছে না, কি হচ্ছে? উঠতে থাকল, উঠতে থাকল। প্রায় দশ মিনিট। উঠেই যাচ্ছে উঠেই যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, আরে একতলাটাই না? হ্যাঁ এতো একতলাটাই! দরজাটা হাঁ করে খোলা। বাচ্চাগুলো সার দিয়ে মেঝেতে শুয়ে। চারদিকে কি ওগুলো, রক্ত!
     সে আবার উঠতে শুরু করল। আধঘন্টা ওঠার পর তার মনে হল সে যেন ছাদে। ওরা কারা দাঁড়িয়ে?



------
ভোর হল। অঞ্জনের বডিটা প্রথম দেখে রহিম। সে গাড়ু নিয়ে বেরিয়েছিল প্রাতঃকৃত্যে। সে দৌড়ে রতনকে খবর দেয়। ক্রমে এ গ্রাম সে গ্রাম থেকে বহু লোক জড়ো হয়। মাথাটা থেঁতলানো অবস্থায় অঞ্জন মাটিতে পড়েছিল। গায়ে একটা তন্তুও ছিল না। ছাদের থেকে পড়েছে অনুমান। পুলিশ আসল আরো বেলায়। জিজ্ঞাসাবাদ করে বডি নিয়ে গেল পোস্টমর্টেমে। বাড়ির লোকের সন্দেহে রতনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। আরো কিছু অসংলগ্ন কথা রতন নাকি বলছিল ভুতটুত আজগুবি সব কথা, পুলিশ বিশ্বাস করেনি, সন্দেহ বেড়েছিল আরো।
      বাড়িটা বিক্রি হয় আরো বছর দুই পর। একজন সাউথ ইন্ডিয়ান উদ্ভিদবিদ কিনলেন। মার্চের মাঝামাঝি চলে আসলেন একাই। ওনার খুব ছবি তোলার শখ। দামি ক্যামেরা। একদিন ফিল্ড ওয়ার্ক করে বাড়ি ফিরে দেখেন, ক্যামেরার কাঁচটা ভাঙা, আর সামনের দেওয়ালে তাঁর মায়ের ছবিটা নেই। অথচ ফ্রেমটা অটুট অক্ষত। তিনি মোবাইলে ডায়াল করতে যাবেন এক বন্ধুকে, হঠাৎ মনে হল, কেউ একটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যে হয়েছে, আলো নেই, কারেন্টের খুব সমস্যা, তা ছাড়া ভোল্টেজও খুব কম থাকে। তিনি বললেন, "কে?" সে উত্তর দিল না। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। তারপর কেমন হিসহিসে গলায় বলল, "আমি অঞ্জন, একবার ছাদে যাব?"