Skip to main content

        একটা গোলাপী শাড়ি। মাথায় দুটো ক্লিপ। অনেক দিন হেলায় পড়ে থাকা, ঝড়ে ভাঙা গাছের ডালের মত শরীর। জোর বলতে --- গলা আর চোখ। বিরক্তিকর ফ্যাসফ্যাসে গলা, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ জ্বালা ধরানো দৃষ্টি।
        শ্মশানে থাকে। ডোমের কাজে সাহায্য করে। ডোমের ঘরণী নয়, তবু আদিম রিপু আর সমাজের টানাপোড়েনে সে ডোমের সহকারী থেকে একটু কিছু বেশি। 
ছাপরায় বাড়ি ছিল। বাবার দশ কুড়ি মেয়ের মধ্যে কখন সে জন্মেছিল, কখন সে চোদ্দোতে পা দিয়েছিল, তার মা মরেছিল, সে শাফিলের সাথে পালিয়েছিল কলকাতায় --- তার বাবা খোঁজ রাখার মত অবস্থায় থাকত না, মদের দাপট পিতৃত্বের দায়ভার ভুলিয়েছিল অনায়াসেই। দিদিরা একে একে লাইনে নামছিল। সে চায়নি। পালিয়েছিল। চারটে মেয়ে হল। শাফিল ছেড়ে পালাল। সে কি করে কি করে এই শ্মশানের কাজে এলো। চারটে মেয়েকে সে কি করে মানুষ করবে ভাবে না, ভাবে কি করে বাঁচিয়ে রাখবে। মেয়ে মানুষের শরীর, ও খানিক বড় হলেই খদ্দের জুটে যাবে। নিজে যা করেনি মেয়েগুলো করলে এখন আর তার আপত্তি নেই। পুরুষের কলিজার চেয়ে কামের ওপর বিশ্বাস অনেক বেশি। প্রেম যায়, কিন্তু কাম যায় না।
        আজ রান্নাতে মন দিয়েছে। মড়াও বেশি নেই। চুল্লীটা খারাপ হয়ে পড়েছিল ক'দিন। তারপর ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রী কলকাতা থেকে এসে সারিয়েছে। যে কয়দিন ছিল না, বাপ রে বাপ, কাঠে পোড়াতে যে কি ঝক্কি! রান্নাটায় হলুদটা বেশি পড়ল। হাত ফস্কেই পড়ল। অন্যমনস্ক আজ। শাফিলের কথা মনে আসছে। শাফিলের কথা মনে পড়লেই তার সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় রাগে। মনে হয় বাচ্চাগুলোকে গলা টিপে মারে। 
        হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। জোরে একটা লাথি মারল ফুটন্ত ডালে। ছিটকে গিয়ে কড়াইটা মাটিতে পড়ে গোলগোল ঘুরতে লাগল। ডাল মাটির মেঝেতে পড়ে একটা সরু সাপের মত ঢাল বেয়ে জালির দিকে এগোতে লাগল। বাচ্চাগুলোর চোখেমুখে আতঙ্ক। এবার তাদের পালা। কিন্তু না, গঙ্গায় গিয়ে লাফ দিল। সাঁতরে ওপার যাবে। আবার এ পার আসবে। রাগটা কমবে হয় তো।

- সারা গা ভিজে তো
        মন্দিরের পূজারী। ষাটের কাছাকাছি বয়েস। গঙ্গা পেরিয়ে সে সদ্য এ পারে এসে বসেছে, পূজারী ঘটে গঙ্গার জল ভরতে এসেছিল সে সময়। 
- তুমি ডোম তো
- হ্যাঁ 
- রাম স্বামী তোমার?
- হ্যাঁ
- শাড়ি ছাড়বে?
- আপনি ছাড়াবেন? 
        পূজারীর চোয়ালগুলো শক্ত হল। নাকের পাটা ফুলে উঠল। কঠিন গলায় বলল, চাইলে ছাড়াতেও পারি, পরাতেও পারি। 
        সে উঠে দাঁড়িয়ে পূজারীর সামনে দিয়ে আঁচলটা ঝাঁকুনি দিয়ে এগিয়ে গেল, বলল, চল। ভিজে আঁচলের জল চোখে-মুখে ছিটকাল, ঘটে ভরা গঙ্গাজলে মিশল।


        একটা কালী মন্দির। মন্দিরের থেকে কিছুটা দূরে দুটো ঘর করা। পূজারী থাকে। তার পরিবার থাকে দেশের বাড়ি। সে উঠানে এসে কলপাড়ে গেল। পা-টা ধুয়ে, মন্দিরের কালীকে প্রণাম করে পূজারীর ঘরে ঢুকল। দরজা ভিতর থেকে দিল আটকে। 
পূজারী কয়েক মূহুর্ত হাতে জলের ঘট নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মন্দিরে ফিরে এলো। আজ সোমবার। মন্দির ফাঁকাই থাকে। এইদিকটাতে আসেও না কেউ তেমন। পূজারী পূজোয় মন দিল, কান বন্ধ ঘরের দরজায়। 
        খট্ করে আওয়াজ হল। পূজারী পূজো অসম্পূর্ণ রেখেই দরজার দিকে এগোলো। তার ঘাম হচ্ছে। বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করছে। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এক্ষুণি। 
        পূজারীর একটা সাদা ধুতি জড়িয়ে খাটে শুয়ে সে চিৎ হয়ে। চুলগুলো মেঝের দিকে ঝোলানো। তাকে দেখেই ঘাড়টা কাত করে হাসল। ধুতিটা টান মেরে খুলে ফেলল মেঝেতে।


        পরেরদিন বিকালে পূজারীর গলাকাটা শরীর ময়নাতদন্ত হয়ে শ্মশানে এলো। সে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল। কথা বলল না। আসলে আর কোনোদিন কথা বলেনি সে। পরের সপ্তাহে পুলিশ নিতে এলো যখন নিঃশব্দে বিনা প্রতিবাদে গাড়িতে গিয়ে উঠল৷ ছোটো বাচ্চাটার তার পায়ের সাথে জড়িয়ে কান্নাও তাকে টলালো না। ফিরেও তাকায়নি। তাকে যতবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছে সে কেন করল, সে কোনোবারই কোনো উত্তর করেনি।
        জেলে দেড় বছরের মাথায় কি একটা জ্বরে পড়ে মারা গেল। 
        তার পাশের কয়েদী বলেছিল, সে নাকি জ্বরের ঘোরে 'আব্বাজান... আব্বাজান' বলে কয়েকবার ডেকেছিল।