Skip to main content
ashirbaad

 

কেউ একজন দরজা খুলে বাইরে ডাকবে। বলবে, এসো। তুমি বাইরে এলেই সে মিলিয়ে যাবে।

তুমি বাইরে এসে দাঁড়াবে। তোমার ছায়া ঘরের ভিতর থেকে বলবে, সব হারাবে যে এবার! ভিতরে এসো।

তুমি অর্ধেক মন নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে। কি করবে বুঝে পাচ্ছ না। পুরোনো অভ্যাসেরা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, তোমার ফেরার অপেক্ষায়। গতজীবনের সুখ জানলায় দাঁড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে। বলছে, এসো, এসো। যা নিশ্চিত, তাকে এইভাবে ফেলে যেও না।

সব চাইতে কঠিন এই সময়টা। তুমি ফিরতে চাইলে ফিরতেই পারো। কিন্তু ফিরে আগের মত ঘোরমগ্ন থাকতে পারবে না। তোমার গায়ে লেগেছে বাইরের হাওয়া। তুমি বুঝতে পারছ তা।

কল্পনার আরেক নাম ভয়। বিশ্বাস করবে ভয়কে? নাকি একবার অবিশ্বাস করবে ভয়কে? অবিশ্বাসও বিশ্বাস। অনেক সময় অবিশ্বাস থেকে জন্মায় গভীর বিশ্বাস।

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বাইরের আলো নিভল। ঘরের আলো জ্বলে উঠল। দুর্বল মন বলল, যাবে? কিন্তু যে দুর্বলতাকে দুর্বলতা বলে জানে, সে বলল, সে আলো কৃত্রিম। দাঁড়াও আরেকটু। অপেক্ষা করো। বাইরের আলোটাই গেছে। বাইরেটা তো যায়নি!

তুমি এখনও দ্বিধায়। যদি ফিরি, তবে সব কিছু নিশ্চিত। কিন্তু কেন এ অনিশ্চিতের টান? কি অমোঘ টান!

ধীরে ধীরে জ্বলে উঠল তারার আলো। ঘরের আলো উজ্জ্বল। তুমি আবার ভাবলে, ফিরে যাবে কিনা। গেলেই তো হয় - দ্বিধা-ক্লান্ত মন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। ভাবনায় অবসন্ন শরীর। চেতনা। আনন্দ নেই। সংশয়াকুল চিত্ত। এবার?

ধীরে ধীরে ঘিরে ধরল কুয়াশা। ঘরের আলো আবছা। ঘরের পথ, চেনা পথ। খুঁজতে বেগ পেতে হবে না। কয়েক পা এগোলেও। তবু দাঁড়ালে। ক্লান্তি, অবসন্নতার পার দেখতে পায় যে বোধ, সে বলল,

“দাঁড়াও। সব মিথ্যা হবে না। হতে পারে না। বাইরেটা যদি মিথ্যা হয়, তবে ঘর হবে আরো মিথ্যা। যে বিশ্বাস জন্মায় প্রাণের থেকে, সে নাড়ির বিশ্বাস। যে বিশ্বাসে শিশু হাত বাড়ায় মায়ের দিকে। হাসে মায়ের হাসিতে হাসি মিলিয়ে। মায়ের স্তনে রাখ মুখ, নিশ্চিন্তে। সে বিশ্বাস নাড়ির বিশ্বাস। সে নাড়ির বিশ্বাসকে কোরো না উপেক্ষা। ক্ষণিক অবসন্নতায়, মোহে, দুর্বলতায় বঞ্চিত কোরো না নিজেকে। হেরে যেও না। ধৈর্য ধরো।”

তুমি দাঁড়ালে। নিজের বিরুদ্ধে গিয়েই নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখলে। যেন সময় থেমে আছে। যেন ঘরের আবছা আলো নিশ্চিত সুখের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তোমায় বিদ্রুপ করছে।

এক সময় মনে হবে তুমি আর পারবে না। সবটাই হল ব্যর্থ। ঠকালে নিজেকে। হলে প্রতারিত মহাকালের চাতুরীতে।

তবু পারের ওপারে জাগা কোনো বোধ বলল, দাঁড়াও।

কুয়াশা সরতে লাগল। তুমি তাকিয়ে দেখলে পুবাকাশে ক্ষীণ আলোর রেখা। তোমার অবসন্নতা, ভয়, দ্বিধা মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে শিশিরের মত। দিগন্তে যে আলো ফুটল, সে আলোয় লেখা তোমার নাম। তোমার সেই নাম, যে নামে কেবল তুমি নিজেকে ডাকো, যে নামের খোঁজ আজ অবধি বাইরের সংসারে কেউ পায়নি। তুমি নতজানু হলে। সাশ্রু নয়নে বললে, কে তুমি? জানলে কি করে আমার এ নাম!

কয়েকদিন পড়ে রইলে এমন প্রবল আনন্দাহত হয়ে। তারপর একদিন যখন উঠে দাঁড়ালে, মাথার উপর তখন জ্বলন্ত সূর্য। শকুন, চিল উড়ছে মাথার উপর দিয়ে। গোটা জগতের দিকে তাকিয়ে দেখলে যেন খাদ্য-খাদকের মহাযুদ্ধ বেধে আছে। কিন্তু তোমার ভয় হল না। এ ছবি তোমার ভীষণ চেনা। ধীরে ধীরে মনে পড়ল তোমার ঘরের কথা। সুখের কথা। নিশ্চিত জীবনের কথা। তোমার ঠোঁটের কোণায় জন্মালো করুণার হাসি। আত্মকরুণা। যা সব করুণার মাতৃস্বরূপ।

তুমি এক বিশাল বটবৃক্ষের তলায় এসে বসলে। বটবৃক্ষ বলল, এসো। তৃষ্ণাই শুধু সত্য নয়, তৃষ্ণাবারি মিলেই পূর্ণসত্য। অন্ধকার আর আলো মিলেই পূর্ণ সত্য। হিংসা আর অহিংসা মিলেই পূর্ণসত্য।

তুমি বললে, না, সেও আংশিক সত্য, দ্বান্দ্বিক সত্য। পূর্ণ সত্য বোধাতীত। দ্বন্দ্বাতীত। মানুষ অন্ধকারকে চিরকালের জন্য স্বীকার করে না যে আলোর অনুশাসনে, সেই আলোতেই পাতা সে-ই পূর্ণসত্যের আসন। তাঁর পায়ের ধুলো লেগেছে আমার গায়ে। আমি জেনেছি তাঁকে। বোধাতীত, সে আনন্দময়কে। আমি কেউ না। কেউ না। কেউ না।

(ছবি - ইন্টারনেট)