নেই রে…পড়তে গেছে…..,
কুনাল সাইকেলটাতে বসেই একবার বল্লু'র দিকে তাকালো। বল্লু তাকে দেখতে পায়নি ভাব করে খদ্দেরকে ডাল মেপে দিচ্ছে। বল্লু কুনালের থেকে বছর দশেক বড় হবে।
পল্লবী'র মা নেই। টুয়েলভে পড়ে। সায়েন্স। মুদির দোকানের পিছনে বাড়ি। দুটো ঘর। গঙ্গার পাড়ে টয়লেট। ঘর থেকে দূরে। একটা ঘরে বাবা থাকে। আরেকটা ঘরে পল্লবী আর তার অন্ধ ঠাকুমা, সন্ধ্যা।
কুনালও টুয়েলভে পড়ে। কমার্স। ঠাকুমা'র মুখের দিকে তাকিয়ে। সাইকেল থেকে নামল। ঠাকুমার পাশে চৌকিতে গিয়ে বসল। বল্লু বলল, বসলি যে…. পড়তে যাবি না?
স্যার পড়াবে না আজ….. আচ্ছা ঠাকুমা তুমি বোঝো কি করে আমি….
সন্ধ্যা হাসল। একটাও দাঁত নেই। খোলা চোখে ছাদের দিকে তাকিয়ে। বলল, লোকে বলে অন্ধের জগত অন্ধকার…. মিথ্যে কথা বলে…. শব্দ আর গন্ধ নিয়ে আমার জগত…. তোর গায়ে যে সেন্টের গন্ধ….. তোর সাইকেলের চেনের আওয়াজ….
গুলিয়ে যায় না?
না…. তোর গুলায়…. স্কুলের সামনে যখন দাঁড়িয়ে থাকিস…. দুশো তিনশো মেয়ে বেরোয়…..
আজকাল দাঁড়াই না।
লজ্জায় কালো কানদুটো লাল হয়ে গেল কুনালের। পল্লবীর বাবা, সুভাষকাকু থাকলে এদিক মাড়ায় না…. বৃহস্পতিবার করে কাকু নৈহাটি মাল আনতে যায়…. সেদিনই বিকেলে আসে…. কিন্তু আজ তো পড়া থাকে না পল্লবীর….. ফোন বার করল…. হোয়াটসঅ্যাপ করেনি…..
ফোনে পাবি না… ওর ফোন খারাপ…. জলে পড়ে গেছে….
আবার ঠাকুমা বলল। কুনাল বলল, কোথায় পড়া?
ঠাকুমা বলল, কেমিস্ট্রি…. এক্সট্রা পড়াবে…..
কুনাল বলল, আমি বসব?
ঠাকুমা বলল, বসে যা…. ঝড় আসছে…. কালবৈশাখী…..
কি করে বুঝলে?
হাওয়া শুঁকে
=========
পল্লবীকে ছাড়…. ওর মন নেই তোতে… সময় নষ্ট করছিস…..
কুনাল চুপ। ঠাকুমা আগেও বলেছে। কিন্তু….
বল্লু দোকানে নেই। বাইরে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে কুনাল বসতে যাবে…. ঠাকুমা বলল, ঘরে যা…. বাঁদিকের ঘরে…. খাটের নীচে ইঁটের উপর দেখ একটা মোমবাতি আর দেশলাই আছে… নিয়ে আয়।
মোবাইলের টর্চ জ্বেলে ঘরে ঢুকল। খাটের পায়ার নীচে পাতা ইঁটের উপর মোমবাতি আর দেশলাই রাখা। টর্চটা দেওয়ালে ফেলল। পল্লবীর ছবি। স্টুডিওতে। শাড়ি পরা। পাশে নতুন শাড়ি পরে ঠাকুমা আর কাকু।
পা টিপে টিপে গিয়ে ছবির সামনে দাঁড়ালো। চুমু খেল। পল্লবী'র পুরো মুখ জুড়ে। মোমবাতি আর দেশলাই নিয়ে দোকানে এসে মোমটা ধরাতে গেল, ঠাকুমা বলল, ছবিটায় ঠোঁটের দাগ দিলি… মুছেছিস?
কুনাল বলল, যত্তসব… কোথায় ছবি….
ঠোঁটটা ধুয়ে নে… টিকটিকির গু-টু থাকতে পারে…..
অলক্ষ্যেই হাতটা দিয়ে ঠোঁট মুছে নিল কুনাল…. পল্লবী সত্যিই তাকে ভালোবাসে না?
না….. তুই ওকে ছাড়….
=========
ঝড় থামল। কুনাল বলল, উঠি?
ঠাকুমা বলল, যা, দোকানের ঝাঁপটা তুলে দে এবার…. যাওয়ার সময় বল্লুকে চায়ের দোকানে একটা হাঁক দিয়ে যাস…. আর শোন পল্লবীকে ব্যাচের সামনে পাবি না… ও ওখানে নেই….
তবে?
কুনালের বুকটা ধক্ ধক্ করছে।
ও বল্লু'র মোবাইলে অনেকক্ষণ ধরে মেসেজ করছিল… বল্লু'র টেপা মোবাইল… মনে হচ্ছিল হাত কাঁপছে…. হয় তো নতুন কেউ…. আজ সে সেন্টটা দিয়ে গেছে…. ওটা ব্যাচে যাওয়ার সময় দেয় না….
কে হতে পারে?
বাইক আছে…. সিগারেট খায়… সকাল দশটা নাগাদ দোকানে সিগারেট কিনতে আসে…. আমার দিকে তাকায়… শিস দেয়…. ইশারায় কথা হয়……
অন্তুদা? কয়েকবার বাইকে দেখেছি…. কিন্তু অনেক বড় তো…..
বাড়ি যা… আর বল্লুকে…..
হ্যাঁ বলে যাচ্ছি।
=========
অন্তুদা'র বাইকটা ক্লাবের বাইরে রাখা। রবীন্দ্র জয়ন্তী হচ্ছে। পল্লবী'র চটিটাও রাখা।
বুকটা পায়ে খিঁচ ধরা ব্যথার মত আটকে গেল।
মাথাটা কেমন কুকারের মত সাঁ সাঁ করছে। কান গরম হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে ঘড়িটা দেখল। গঙ্গার ধারে বসে থাকল ঘন্টা দেড়েক। কান্না গিলে নিল। অন্তুদা ভালো ছেলে নয়। পার্টিতে হোল্ড আছে ওদের বাড়ির সবার, তাই লোকে বুঝে চলে… কিন্তু কাকুকে তো জানানো দরকার…..
সাইকেলটা নিয়ে দোকানের বাইরে দাঁড়ালো। অন্তুদা'র বাইক। ভিতর থেকে কাকুর গলাও আসছে। হাসাহাসি হচ্ছে।
বাড়ি যা….
ঠাকুমা এসে দাঁড়িয়েছে অন্ধকারে। হাতে গরম চপের ঠোঙা। গন্ধ বেরোচ্ছে। খিদে পেয়েছে অনেকক্ষণ। খাওয়া হয়নি তো।
কিন্তু….
বড় হলে বুঝবি…. ভালোমন্দের হিসাব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়…..
তুমি কিছু বলবে না?
না….. তুই বাড়ি যা…. আর আসিস না.. .. অন্তু ভালো ছেলে না…..
মানে তুমি….
আমরাও ভালো না….. তুই বাড়ি যা….