এবারের পূজোর ছুটিতে আমরা বন্ধুরা মিলে অজন্তা বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফর্দাপুর বলে অজন্তা সংলগ্ন একটা জায়গায় একরাত্রি হোটেল বাস করতে হয়েছিল।
সকালবেলা হোটেলের বয় আমাদের ঘরে চা দিতে এলো। ঘরের দ্রব্যসামগ্রীর দিকে ধাঁ করে একনজরে চোখ বুলিয়েই, হঠাৎ তার মুখটা সলজ্জ দুষ্টু হাসিতে রক্তিম হয়ে উঠল। তারপর একটু সংকোচের সাথেই বলল, সাহাব, এক বাত পুছে?
বললুম, বোলো।
আপ বাঙ্গলী লোঁগো কে সাথ এক গোলি কা ডিব্বা কিঁউ হোতা হ্যায় হর বখত?
লক্ষ্য করলুম, তার চোখ টেবিলের উপর রাখা ওষুধের কৌটোর দিকে। তাতে অম্বল, পেট খারাপ, জ্বর ইত্যাদি সম্ভাব্য রোগাদির ওষুধ।
সে আরো বললে, "আপকে পাস তো ইতিনি সি ডাব্বা, উপরকে কামরে মে জো বাঙ্গালী লোগ হ্যায় উসকে পাস ইতনা সা বড়া ডাব্বা (হাতের যা সাইজ দেখাল, তা আনুমানিক একটা প্রমাণ সাইজের মুরগীর সমান হবে)
"ওউর ভি লোগ আতে হ্যায়, পর উনকে সাথ গোলি কা ডিব্বা তো নেহি হোতে হর সময়! আপ বাঙ্গালী লোগকে সাথই হোতে হ্যায় জরুর।"
তাকে এটা সেটা বুঝিয়ে তো নিরস্ত করা গেল। কিন্তু অবচেতনে কোথাও যেন একটা সুড়সুড়ি লাগল। এ কথাটা আমার মাথায় আগেও এসেছে। আমরা বাঙালীরা কি একটু রোগবিলাসী?
যেখানেই বাঙালীদের গল্পাতে দেখেছি, সে হরিদ্বার হোক চাই উত্তরপাড়া, লাভা হোক চাই ভাইজাগ... মাঝবয়সী থেকে বয়স্কদের মধ্যে রোগ নিয়ে বেশ আবেগপূর্ণ আলোচনার বহর দেখেছি। সুগার, থাইরয়েড, প্রেশার, আর্থারাইটিস, বদহজম ইত্যাদি তো আছেই। তার সাথে উইকিপিডিয়ার শরণাপন্ন হতে হয়, এমনধারা রোগেরও বিশদবিবরণ শুনেছি। বেশ আত্মাভিমানের সাথে।
একটা উদাহরণ দিই। লাভার সরকারী গেস্ট হাউসে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে চাদর জড়িয়ে প্রাকৃতিক শোভায় প্রথম চুমুকটা দিয়েছি কি দিইনি, অমনি পাশ থেকে শুনলুম,
- মিত্তিরদা আজ কেমন হল?
- আর বলবেন না, জল কম খাওয়া হয়েছে। পুরো প্রসব বেদনার মত বেদিয়ে (নতুন শব্দ) ছাড়লে!
- আমারও তাই। ওকে (স্ত্রীকে) কত করে বললুম কায়েম চূর্ণটা নাও নাও। সেই ভুলল! এখন এই এক পেট ...... নিয়ে কি আর কাঞ্চনজঙ্ঘায় মন আসে?
- আচ্ছা আপনি কায়েম চূর্ণ খান?
ওনার গলার আবেগ শুনে মনে হল, কায়েম চূর্ন'র নাম শুনে এবার তার ভাবসমাধি না হয়!
- তা আপনি অমুকটা ট্রাই করছেন না কেন?.....
শুরু হল বাহ্যলীলাপ্রসঙ্গ। সেদিকে আর গেলাম না।
আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেককেই দেখেছি, মাসে একবার করে 'রায়-ত্রিবেদী', কি 'সুবীর দত্ত' যান কিম্বা নিজের দেহাংশের নমুনা পাঠান নিয়ম করে, বারের পূজো বা তীর্থদর্শনের মত নিষ্ঠা নিয়ে। কোনো রোগ না পেলে মনঃক্ষুণ্ণ হতেও দেখেছি। ভাবটা এমন, 'আহা, তেমন করে খুঁজলে কি ওরা নিদেনপক্ষে কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত সুগারও কি পেত না! না হয় প্রি-ডায়াবেটিক'ই লিখত'। তাদের ইচ্ছা করে বলতে, "ভেঙে পড়বেন না, পরেরবার নিশ্চই কিছু একটা বেরোবে। ঈশ্বর সবসময় বিমুখ হন না। হাল ছাড়বেন না।"
আর চিকিৎসাক্ষেত্র? ভেলোর, অ্যাপোলো তো মক্কা, কাশীর থেকেও পবিত্রভূমি। মানসিক রাখার মত যেতেই হয় ফি বছর। চেন্নাইতে বন্যা হল, বাঙালী ভগ্নমনোরথ রোগীদের নিয়ে আনন্দবাজারে আধপাতা খবর হল। এটা বাড়বাড়ি কি?
স্বাস্থ্য সচেতনতা নিশ্চই ভাল। কিন্তু স্বাস্থ্য বাতিক?
আমার প্রশ্ন হল, আমরা বাঙালীরা কি সত্যিই একটু রোগবিলাসী? এই নিয়েই একটু শুনতে চাই আপনাদের কাছে। কি মত? অপেক্ষায় রইলুম অধীর আগ্রহে, একটা critical thinking এর আশায় সক্কলের কাছ থেকে।
সৌরভ ভট্টাচার্য
10 December 2015