পায়ের গিঁটগুলো শক্ত হয়ে গেছে। কালো। দইয়ের বাঁক নিয়ে স্টেশানে এসে দাঁড়ালো যখন আষাঢ়ের আকাশ জুড়ে প্রথম বর্ষার মেঘ।
ডাউন শান্তিপুর লোকাল চলে গেল। দইয়ের দুটো বড় পাত্র নিয়ে স্টেশানের মেঝেতে বসল। হালিশহরে যে এই প্রথম আসা তা তো নয়। তবু হালিশহর স্টেশান কেন, রোজকার দিনই তো নতুন। এই পঞ্চান্ন বছর বয়সেও কোথাও কিছু পুরোনো চোখে পড়ে কই? ভালোবাসা থাকলে সব নতুন। ভালোবাসা না থাকলে সব পুরোনো।
সনাতনের উঠতে ইচ্ছা করছে না। দুপুর দেড়টা হবে। ডাক্তার বলেছে আর এক বছর। পেটের মধ্যে খাদ্যনালীতে ঘা। সে ঘা নাকি ভালো নয়। ক্যান্সার। সনাতনের এত তাড়াতাড়ি মরে যেতে ইচ্ছা নেই। কিন্তু মৃত্যু তো তার কথা শুনে আসবে না। সেকি নিজের ইচ্ছায় জন্মেছিল? তবে?
সনাতনের দুটো চোখ জলে ভরে এলো। বড্ড মায়া এই জগতটার উপর। ভীষণ মায়া। সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটায় কত ফুল। প্লাটফর্মেও ছড়িয়ে আছে। কালো মেঘের গায়ে লালফুলগুলো দেখে মনে হয় এই পৃথিবী তাকে কিছু বলছে। সাজো সনাতন সাজো। তোমার ঠাকুর তোমার জন্য রথ সাজাচ্ছেন। সনাতন সাজো। তোমার ঠাকুর আসছেন তোমায় নিতে। তোমার ঠাকুরের এমনই গায়ের রঙ না? ভালো করে দেখো। তোমার রক্তের রঙও তো ওই কৃষ্ণচূড়ার রঙের মত। না সনাতন? এসো, তাকাও, দেখো।
সনাতন ঝাপসা চোখে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ তো। আমার জগন্নাথের রঙ তো এমনই। সনাতনের চোখদুটো বন্ধ। বন্ধ পাতার ভিতরে জগন্নাথ আসছেন। রথে চড়বেন। ভক্তের ভাবের দোলায় দুলতে দুলতে আসছেন জগন্নাথ। সনাতনের বন্ধ চোখের পাতা ঠেলে নামছে জলের স্রোত। গাল গড়িয়ে নামছে। সনাতন রথের রশি ধরে দাঁড়িয়ে। ঠাকুরকে বলছে, ওঠো ঠাকুর, ধীরে ধীরে ওঠো, বসো, আমি আছি, ভয় নেই।
সনাতনের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটল। যেন মেঘের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলো। ঠাকুরকে বলছে, ভয় পেয়ো না!
বলবেই তো। এখন তো সে সসীম। অসীম ধ্যানের বস্তু। সসীম ভাবের। সব মানুষের এক এক ভাব। কারোর ভাব শরীর নিয়ে। শরীরের নানা জায়গায় নানা ভাব। শরীরকে সুখী করে নিজেকে সুখী করে। হালকা মানুষ। বুকের মধ্যে যে ভাবের বাসা, সে খাঁটি। সে জমলে শরীর সাড়া দেয় না, আকাশ সাড়া দেয়, গাছ সাড়া দেয়, মাটি সাড়া দেয়। সনাতন তখন আকাশ, মাটি, বাতাস, জল। সব কিছু।
একজন এসে দাঁড়ালো সামনে। বলল, দই কত করে দাদা?
সনাতন হাসল। বলল, দই নাই। অল্প এনেছিলাম কাঁচরাপাড়াতেই সব বিক্রি হয়ে গেল।
লোকটা চলে গেল। সনাতনের খারাপ লাগল। কাউকে ফেরাতে ভালো লাগে না। কিন্তু শূন্যহাত তো হয় মানুষের। ফেরাতেই হয়। ব্যথা লাগে। ব্যথায় অহংকারে ঘা লাগে। নড়েচড়ে ওঠে মাথা। ঘাসের উপর হাঁটলে ঘাস যেমন করে ওঠে। ঘাস আবার মাথা তোলে। আবার কেউ মাড়িয়ে যায়। সনাতন ঘাসের উপর দাঁড় করিয়েছে ঠাকুরকে। মাথা তুলতে যেন না পারে দেখো।
সনাতন তো সংসারে একা নয়। তার বউ আছে। ছেলে আছে, সে মিস্ত্রীর কাজ করে। মুসলমানকে বিয়ে করে এনেছে। সনাতনের বউয়ের আপত্তি ছিল। সনাতন কানে নেয়নি। ভালোবাসা জলের মত, ও কেটে আলাদা করা যায় না। গাছের শিকড় যেমন জল চিনে চিনে মাটির নীচে যায়, ভালোবাসাকেও তেমন চেনে মানুষ। শিকড় চালায়। জল পেলে বাঁচে। না পেলে শুকিয়ে মরে। জল মানে ভালোবাসা। ভালোবাসার কোনো জাত হয় না। সে চিরকাঙাল। সব পেয়ে, সব হারিয়ে। শূন্যতাতেই তার সুখ। জমলে তার শ্বাস আটকে আসে। তার ভালোবাসার মানুষটার চোখের দিকে তাকালেই সে দেখে সুখের পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে মরণ।
চোখ মানে ভালোবাসা। দৃষ্টি মানে ভালোবাসা। তাই প্রভু জগন্নাথের মুখ জুড়ে শুধু চোখদুটোই দেখার। মানুষ চোখ দেখে জুড়ায়। সেই চোখই রথে চড়ে চোখ দেখতে বেরোয়, অসীমের চোখ সসীমের ভালোবাসায়। এসো প্রভু, এসো, রাস্তায় এসে নামি দাঁড়িয়ে আমি। প্রভু এসো, আমার জন্যে রথে নেমেছ তুমি, আমায় নাও।
সনাতন প্ল্যাটফর্মে শুয়ে। বৃষ্টি নেমেছে অঝোরে। সনাতন রথ দেখতে পাচ্ছে। কালো মেঘের মধ্যে থেকে প্রভু আসছেন। তার প্রভু, কালোর কালো। তার ভালোবাসায় ডোবা চোখ। সনাতনের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বৃষ্টির জলে সব ঝাপসা। ক্রমে রথ এগিয়ে আসছে।
শূন্য দইয়ের পাত্রে জমছে বৃষ্টির জল। সনাতনের প্রাণহীন শরীরের উপর উড়ে এসে পড়ল একটা কৃষ্ণচূড়ার ছোটো ডাল। লাল ফুলগুলো পড়ল তার শরীরে ছড়িয়ে, সনাতনের হাতের উপর এসে পড়ল কিছু ফুল। সনাতন যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে তার প্রভুকে। এসো, আমি তৈরি, সেই কবে থেকে!