মানুষটা আমগাছের চারাটা লাগিয়ে, কয়েকদিন মাত্র নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল। ভেবেছিল, গাছটা না হলেই ভালো। কিন্তু একদিন ভোর সাড়ে চারটে উঠে বাগানে এসে যেই দাঁড়িয়েছে, তার চোখ ঠোক্কর খেল দুটো সবুজ পাতায়, একটা চারাগাছ জন্মিয়েছে।
সেদিন থেকে লোকটার ঘুম গেল। তার বারবার মনে হচ্ছিল, এই গাছটা আমগাছই হবে তো? রাম-শ্যাম-যদু-মধু সবাইকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, "হ্যাঁ গো, এটা আমগাছই তো?"
তারা সবাই বলল, "হ্যাঁ তো, তুমি তো আমের আঁটিই পুঁতেছিলে, আম হবে না?"
লোকটা ঠোঁটের আগায় একটা সন্দিগ্ধ হাসিকে জন্ম দিতে দিতে বলল, "তাই তো, তাই তো"।
দেখতে দেখতে গাছটা বড় হল। মেলা ডালপালা হল। পাখির বাসা হল। বসন্তকালে পাতা ঝরল। লোকটা সে ঝরাপাতাও কোনার ঘরে ডাঁই করে রেখে দিল, যদি গাছটা কোনোদিন চেয়ে বসে, দেখতে চায়?
তারপর গাছটা ছেয়ে বোল হল। লোকটার দুশ্চিন্তা গেল আরো বেড়ে। এগুলো কি সত্যিই আমের বোল? সে রহিম-করিম-শরিফ-রেজ্জাককে ডেকে বলল, "হ্যাঁ গো, এগুলো কি সত্যিই আমের বোল?"
তারাও সমস্বরে বলল, "তুমি তো আমগাছই লাগিয়েছ, তবে এ তো আমের বোলই হবে"।
লোকটা চোখের মণিতে কপট বিশ্বাসকে জন্ম দিতে দিতে বলল, "তাই তো, তাই তো"।
কত বছর হয়ে গেল লোকটা ঘুমায় না। অবশেষে গাছ ভরতি আম হল। লোকটা আমগুলোকে দিনে দেখল, রাতে দেখল, উঁচু করে দেখল, নীচে রেখে দেখল, দূরে রেখে দেখল, কাছে এনে দেখল। একে তাকে জিজ্ঞাসা করল। সবাই বলল, "হ্যাঁ এ তো আমই"। সে বলল, মিষ্টি? সবাই বলল, হুম তো! লোকটা তাই শুনে কখনও হাসে, কখনও কাঁদে, কখনও গম্ভীর হয়ে বসে থাকে কোলে আমের ঝুড়ি নিয়ে। আমগাছটার নীচে দাঁড়িয়ে রাতে একা একা কথাও বলে ইদানীং।
লোকে বলল, সে পাগল হল। সে কিচ্ছু বলল না কাউকে। কপট হাসি হাসল। যেন বিশ্বাস করেছে, এমন হাবভাব করে। আসলে সে কাউকেই বিশ্বাস করতে পারে না, তার বিশ্বাস যেমন কেউ রাখেনি, সেও এখন কারো বিশ্বাস রাখতে পারে না। চাইলেও পারে না। এটা সে বোঝাতেও চায় না কাউকে। বোঝালেই যে সে বুঝবে, সে বিশ্বাসও রাখতে পারে না সে।