ফ্লাশ করে মনোরমা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বাথরুমে। স্নান করবে না ঠিক করেইছিল সকাল থেকে। জ্বরজ্বর ভাব আছে একটা। জ্বর নেই, এই সিজন চেঞ্জের সময়টায় হয় এটা প্রত্যেক বছর। তবু বাথরুম থেকে বেরোতে ইচ্ছা করছে না মনোরমার। বাথরুমে একটা ছোটো পিঁড়ি মতন আছে, ছোটো ননদ পুষ্পা কিনেছিল। ওর খুব স্নানের শখ ছিল। কতক্ষণ যে দিনে বাথরুমে কাটাত! বিয়ে হয়ে গেছে ওর বছর দশেক হল। মনোরমার নিজের এই ফাল্গুনে তিপান্ন হল।
মনোরমা বাথরুমের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা ছড়িয়ে বসে। গায়ে কিচ্ছু নেই। ভালো লাগছে তার। বাথরুমের জানলার ফাঁক দিয়ে পাশের বাড়ির আমের বোল দেখা যাচ্ছে। একটা কাঠবিড়ালি হঠাৎ নজরে এসে হারিয়ে গেল। মনোরমা সামনে ছড়ানো নিজের পায়ের দিকে তাকালো। আগে নেলপালিশ পরত, ইদানীং পরে না। শাশুড়ি যতদিন ছিলেন আলতা পরত, এখন তাও পরে না। পায়ে শুধু একটা রূপোর আঙট। দিদিমার দেওয়া। দিদিমা বহরমপুরের মেয়ে। তার মা কৃষ্ণনগরের। সে নিজে এই ভবানীপুরে। আচ্ছা, তার দিদিমা, মা এরকম একা বাথরুমে বসে থেকেছে? বহরমপুরের বাথরুম সে দেখেনি, কৃষ্ণনগরেরটা মনে আছে, সেখানেই তো সে বড় হয়েছে, তার মায়ের বিয়ে তো কৃষ্ণনগরেই হয়েছিল। টালির ছাদ ছিল, আর মেঝেটা প্রথমদিকে শুধু ইঁট পাতা থাকত, তার বিয়ে যে বছর হয়, সে বছর বাঁধানো হয়। তার মা বসত সেখানে? তার মত একা, সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নিজের সাথে নিজে?
মনোরমা একটু বাঁদিক কাত হয়ে বসল। দরজার সাথে লাগানো আয়নাটা দেখা যায়। চুলগুলো সাদা হচ্ছে। ডাই করে না। ইচ্ছা করেই করে না। তার ইদানীং 'না' বলতে খুব ইচ্ছা করে সব কিছুতেই। 'না' বলতে ইচ্ছা না করলেও ইচ্ছা করে। চুলে রং করো, নেলপালিশ লাগাও, সবই যেন তার ইচ্ছার জন্যে না, অন্যের জন্য। এক এক সময় নিজের শরীরটার উপর রাগ হয় ভীষণ। ঘেন্না লাগে। কেন বুঝতে পারে না। নিজের শরীরের দিকে আয়নায় তাকাতে তাকাতে মনে হল, তার বয়েসটা হুড়হুড় করে যেন কত বছর বেড়ে গেছে।
“শুষে নিল সব শালা!"... মনোরমা চমকে উঠল নিজের মনের উচ্চারণ শুনে। তবু ভয় পেল না। আজ ভয় পেতেও ইচ্ছা করছে না। না ঠিক তা না, ভয় পাওয়ার মত ইচ্ছা বা বাসনা বা মোহ যাই বলো না কেন, কোনোটাই যেন তার আজ নেই। উদাসীন সে। কে শুষে নিল?
প্রথমে স্বামী, তারপর সন্তান। সে কে? একজনের সোহাগ পাত্র, না বীর্য্যের ডাস্টবিন আজও বুঝল না। আরেকজনের খাদ্য ভাণ্ডার প্রথম জীবনে, পরে তার সব আবদারের ম্যাজিক বাক্স, এখন তার আর তার বাপের মাঝখানে চীনের দেওয়াল... আরো আরো কত কি! তার নিজের অস্তিত্ব কোথায়, কতটুকু? ওদের তো এত মূল্য চোকাতে হল না সংসার চাওয়ার অপরাধে? সংসারের বাইরেও তো ওরা নিজেদের নিয়ে গেল, হাত-পা মেলল... এমন বুড়িয়ে গেল না? তবে সে-ই কেন?
কাঠবিড়ালিটা আবার এসেছে। ও কি আমের বোল খায় নাকি? দু'হাতে করে কি খাচ্ছে? আচ্ছা এ গাছটা তো আর না হোক আট-ন'বছর এখানেই আছে। ওদের বাড়ির আমের বোল তাদের ছাদ নোংরা করছে বলে কোমর বেঁধে ঝগড়াও করেছে... অ্যাদ্দিন তার চোখে পড়েনি কেন? পড়বে কি করে? কত দাবি-দাওয়ার পূরণের কর্ত্রী সে! তার নিজের ন্যাকামিও কি কম ছিল? কম আদিখ্যেতা করেছে সে! অথচ জানত তো সে, এ সব সাজানো... ভিতরে ভিতরে সবাই বুঝে নিচ্ছে নিজেদের হিসাব, পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে নিচ্ছে পাই পাই। সে তো জানত, সবাই সরে সরে যাবে ধীরে ধীরে খোরাকি ফুরালেই। তবু শালা মেয়েমানুষের মন! দু'বার শালা বলল সে! আজ কি বার? বৃহস্পতিবার কি? কেন বৃহস্পতিবার হলে কি হয়? লক্ষীপূজো? লক্ষী! সেই মেয়েমানুষ তো! বোকার হদ্দ, নারায়ণের পা টিপেই গেল, কি পেল? ছিঃ ছিঃ রাম রাম... কি কি ভাবছে সে!
মনোরমা উঠে দাঁড়ালো। শিথিল স্তনদুটোতে হাত রেখে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করল। তার বুকের মধ্যে ধকধক স্পন্দনটা হঠাৎ ভালো লাগল খুব। এই যন্ত্রটা এতদিন শুধু তারই জন্যে চলছে, এর উপর তার শুধু একার অধিকার। চাইলে থামাতেও পারে।
মনোরমা শাওয়ারটা অন্ করল। খুব ধীরে ধীরে। বিন্দু বিন্দু জলে ভরে গেল শাওয়ারের মুখ। যেন জল ভরতি বর্ষার মেঘ। শাওয়ারটা হঠাৎ যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসল, ফিসফিস করে বলল, এই মেয়ে!
মনোরমার সারা মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সে হাত পাতল শাওয়ারের নীচে। বিন্দু বিন্দু জলে ভরে উঠল তার আঁজলা। খুব আদরের সাথে মুখে মাখল, গলায় মাখল। আবার ভরল বিন্দু বিন্দু জলে আঁজলা- বুক, নাভি, উরু সব ভেজালো। তার চোখ বন্ধ। সে মনে মনে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। তার চোখের নীচে কালির দাগ মুছে যাচ্ছে, তার কুঁচকানো চামড়ার দাগ মিলিয়ে যাচ্ছে, তার সারা শরীরে কৃষ্ণনগরের মনোরমার লাবণ্য। সে প্রেম চায় না, সংসার চায় না, কিচ্ছু চায় না... সে একটু নিরিবিলি চায়... সে একটু নিজের দিকে ফিরে তাকাতে চায়... সে এবার শুধু নিজেকে চায়... আর কারোর মঙ্গল না, নিজের মঙ্গল চায়। বিনা পাঁচালীতে, বিনা উপোসে, বিনা খোঁপায়, বিনা আনুগত্যে। হাত-পা মেলতে চাইছে প্রাণপণ।
হঠাৎ কি হল। মুখের ভাবটা বদলে গেল। যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে খেয়াল করল না সামনের জানলায় কাঠবিড়ালিটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। জোরে শাওয়ার চালিয়ে তার নীচে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে চীৎকার করতে শুরু করল, "কতবার তোর বাবাকে বলেছি বাথরুমের মধ্যে অতবড় আয়না আমার ভালো লাগে না... তা কারোর তো আমার কথা শোনার সময় নেই... হুঁশও নেই... চ্যাটার্জী বাড়ির আমের বোল এতদিনে ছাদের যে কি অবস্থা করে রেখেছে কে জানে... যেদিকটা না দেখব... সব যাবে যাবে..."
বলতে বলতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। থমকে গেল। কান্না পেল। কারা যেন ডাকছে। সাড়া দিতে ইচ্ছা করছে না... আবার 'না' বলতে ইচ্ছা করছে... বেলন-চাকির তলা থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে... অন্যের ইচ্ছায় নিজেকে বানাতে পারছে না আর...
তবু বলল, "আসছি..." । কে যেন হাসল। কে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাথরুমের জানলায় এখন আমের বোল... খাচ্ছে কাঠবিড়ালি।
(ছবিঃ সুমন)