Skip to main content

সবাই উপোস করেছে বাড়িতে। এমনকি তার ন'বছরের ছেলেটা অবধি। মা, বউ, মেয়েও। হরিশের খুব ইচ্ছা সেও একটা মোটর লাগানো বোট কেনে। সারাদিন বৈঠা টেনে টেনে হাতের পেশীগুলো লোহার মত হয়ে গেছে। একটা মোটর লাগানো বোট কিনলেই অল্প পরিশ্রমে কত টাকা! মোটরের দাম পাঁচ লাখ। কিন্তু কোথা থেকে পাবে? তার আর তো অন্য কোনো আয়ের পথ নেই। সেই কুড়ি বছর থেকে এই কাশীতে নৌকা টেনে যাচ্ছে।

আজ শিবরাত্রি। এটা নিয়ে সাত নম্বর শিবরাত্রি বাড়ির সবাই করছে। সবাই মিলে পুজো দিয়ে এসেছে মন্দির গিয়ে। সবাই মানত করেছে একটা মোটর বোট হয়ে গেলে তারা বড় করে পুজো দেবে। মহল্লার সবাইকে খাওয়াবে।

অনেক রাত। ঘুম আসছে না। হরিশ ঘর থেকে বেরোলো। ঘাটের দিকে যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা। ঘাটে নামল। তার নৌকাটা বাঁধা। অল্প অল্প দুলছে। নিজের সন্তানের মত স্নেহ করে হরিশ নৌকাটাকে। আর কতদিন সেও বা পারে। একটা মোটর লাগালেই হয়ে যায়। হরিশ বাড়ি গেল। না ঘুমিয়েই রাত কাটল।

কিন্তু এতবড় দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছিল হরিশ জানতেও পারেনি। পরের দিন অফিসের কিছু লোক এসে বলে গেল তার নৌকা পুরোনো হয়ে গেছে অনেক, এ নৌকা নিয়ে যাত্রী চড়ানো যাবে না। অফিসে গিয়ে দেখা করে যেন হরিশ।

হরিশ জানে তার নৌকা পুরোনো হয়েছে। অনেকবার মেরামত করতে হয়েছে। তবু এতটাই কি খারাপ? হরিশ গেল না অফিসে। নৌকাও চালালো না। এবারেও লটারির টিকিট কেটেছিল, এবারেও লাগল না। হরিশের নৌকা পাড়ে তুলে রাখা। কুকুরের দল ঘুমায় রাতে। বাচ্চারা খেলা করে দিনের বেলায় ওর পাঁজরগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে, দৌড়ে, ঝাঁপ দিয়ে।

হরিশ একটা দোকানে কাজ নিল। মাসে দু'হাজার দেবে। এতে হয় না। হরিশ চার-পাঁচ মাস কাজ করার পর একজন তাকে বলল, তুই হরবিন্দরের কাছে যাচ্ছিস না কেন? ওর তো দশটা নৌকা চলছে, সবক'টাই মোটরের। তুই যা, একটা ভাড়া নে। মাসে মাসে যা পাবি তার অর্ধেক ওকে দিয়ে দিবি।

কথাটা হরিশ ভেবেছে আগে। কিন্ত সারা জীবন নিজের নৌকা চালিয়েছে, গোলামি করবে শেষে? যদিও মোটর লাগানো নৌকা চালানোর শখ তাকে দুর্বল করে দিল। কাজটা হল। এক সপ্তাহের মধ্যে কাজ শিখেও গেল।

হরিশ রোজ সকাল সাতটা থেকে রাত ন'টা অবধি নৌকা চালায়। রোজগার ভালোই হয়। সংসারও চলছে ভালোই। কিন্তু মনে কেন জানি শান্তি নেই। রাতে ঘুম হয় না। খাবার হজম হয় না। এমনকি শিবরাত্রি চলে গেল দুটো, উপোস করতেও ইচ্ছা করল না।

আজ তৃতীয় শিবরাত্রি। হরিশের খুব ভালো রোজগার হয়েছে। কিন্তু ভীষণ মনটাও দমে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না। রাতে গিয়ে ঘাটে বসল। আজ সারা কাশী সাজো সাজো রব। কত আলো চারদিকে। কিন্তু তার মনটা অন্ধকারে ডুবে।

একজন সাধু একটা প্রদীপ জ্বেলে ঘাটের শেষ সিঁড়িতে বসে। ইশারায় হরিশকে ডাকল। হরিশের প্রথমে যেতে ইচ্ছা করল না। আবার ডাকল। হরিশ উঠল না। আবার ডাকল, এবার হরিশ অন্যদিকে তাকালো।

হরিশের পিঠে টোকা..., এই শালা ডাকছি, আসছিস না কেন?

হরিশ থতমত খেয়ে লজ্জা পেয়ে বলল, আমি শুনিনি, দেখিনি।

সাধু বলল, এক গাঁট্টা মারব। আজকের দিনেও মিথ্যা বলে মরছিস?

হরিশের কি হল, গাঁট্টা কথাটা শুনেই বাবার কথা মনে পড়ে গেল। বাবা ওরকম কথায় কথায় মাথায় গাঁট্টা মারত। বাবাও নৌকা চালাতো। তার নৌকাটা তো বাবারই নৌকা - নীলকন্ঠ।

হরিশ বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেঁদে সাধুর পা জড়িয়ে বলল, আমার খুব অপরাধ হয়েছে বাবাআমিআমি

সাধু বলল, আয় আমার সঙ্গে

হরিশ সাধুর পিছনে পিছনে গেল। সাধু এক জায়গায় থেমে, ফিরে বলল, ডাকলে সাড়া দিতে হয়

হরিশ বলল, হ্যাঁ তো বাবাআমি ইচ্ছা করে যাইনিতুমি যদি টাকা চাওছি ছিআমি নীচ আমি লোভী বাবা

সাধু বলল, ডাকলে সাড়া দিতে হয়

হ্যাঁ বাবাবুঝেছি তো

সাধু বলল, বুঝিস নিতোকে কে ডাকছে এতগুলো বছর ধরে?

হরিশ বলল, জানি নানা না, জানি বাবামহাদেব?… না না, বাবা জানি আমি

সাধু বলল, ওই যে দেখও ডাকছে তোকে

হরিশ সাধুর দেখানো আঙুল অনুসরণ করে তাকালোতার নৌকাটাএত এত দিন পরেও জ্বলজ্বল করছে ঘাটের আলোয় লেখাটা, নীলকন্ঠ।

হরিশ কাঁদল। মাটিতে বসে বলতে লাগলআমি নীচ, আমি অন্ধ, আমি লোভী, আমি কালাআমি ভ্রষ্ট

এই এইকি হল রে

কে ডাকে? হরিশ তাকালো। ভোর হচ্ছে। দূরে কোথাও সানাই বাজছে। হরিশ উঠেই দৌড় লাগালো, বাড়ি যেতে হবে। অনেক কাজ, আজই নৌকাটা সারাতে দিতে হবে। তার আগে হরবিন্দরকে বলে আসবে তার কাজ সে আর করবে না। সে ডাকে সাড়া দেবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই।