Skip to main content
half moon

     জল পড়ছে বিন্দু বিন্দু। চালা চুঁইয়ে। এমন বৃষ্টি, বাড়ি ফেরা হল না। আশ্রমে থেকে গেলাম। গোঁসাই খাটিয়ার উপর বসে একতারায় মাঝে মাঝে ঠুং ঠুং আওয়াজ করছে। চোখ বন্ধ। মাঝে মাঝে বলছে, রাধে রাধে।

দরজার কাছে একটা প্রদীপ জ্বলছে। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে যেন নিভে যাবে এক্ষুনি। নিভছে না। মাটির কাছে কাত হয়ে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। বাতাসের দাপটে।

চৌকিতে বসে আছি। সামনে জানলা খোলা। চূর্ণী নদীর উপর বিদ্যুতের আলো এসে পড়লে মনে হচ্ছে একটা সাপ এঁকেবেঁকে যাচ্ছে।

আমার চৌকি আর গোঁসাইয়ের খাটিয়ার মাঝে একদিকে সিংহাসনে শ্রীকৃষ্ণ আর রাধার বিগ্রহ।

গোঁসাই বলল, হয়, হয় জানো, গভীরে ডুবতে চাইলেই হয়। গভীরে না গেলে সংসারে দুঃখ আঘাতে জর্জরিত হতে হয়। বিদ্যাসাগরকে দেখলে না, কেমন শেষদিনগুলো কলকাতা ছেড়ে বাইরে চলে গেল। বড় আঘাত পেয়েছিল মানুষটা। পরিবার, গ্রামের লোক, কলকাতার লোক, বড় কষ্ট, বড় অভিমান।

গোঁসাই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একতারাটা পাশে রেখে পা ছড়িয়ে বসল। কি ভাবছে যেন। আবার খানিক বাদে বলল,

রামকৃষ্ণ ঠাকুর হয় তো বুঝেছিলেন, বারবার করে বলেছিলেন বিদ্যাসাগরকে, ভিতরে সোনা চাপা আছে খবর পাও নাই। সোনা মানে নিজের ভিতরে একটা খুঁটি। রবি ঠাকুরকে দেখো, সেও তো কম জ্বালাপোড়া দিয়ে যায়নি, কিন্তু শেষদিন অবধি সব নিয়েই, সবের মধ্যে থেকে গেলেন। বারবার সরে যাব যাব করেও গেলেন না। যেতে পারলেন না। ভিতরে সোনা আছে। রবি ঠাকুর অনেক কম বয়সে টের পেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতন বইতে বারবার লিখছেন না, বাইরে থেকে নিজেকে ভিতরে আলাদা করো। নইলে বিষিয়ে যাবে সব।

চুপ করে আছি। কি বলব?

গোঁসাই তাকালো আমার দিকে। বলল, তোমরা লেখাপড়া জানা মানুষ, আমি অতশত বুঝি না, যা আমার বিবেকে সত্য মনে হল তাই বললাম, তোমাদের বিচারে ভুলও হতে পারে।

বললাম, সোনা চাপা আছে টের পাই না যে, মনে হয় শুধু ভুষি।

গোঁসাই হাসল। বলল, নিজেকে ছোটো ভাবলে ছোটো ঘরই খুঁজবে। নিজেকে বড় ভাবলে আকাশের নীচে এসে দাঁড়াতে চাইবে। নিজেকে ছোটো ভাবতে যাবে কেন?

সে তো অহংকারের কথা…

গোঁসাই বলল, সোনাকে সোনা ভাবা অহংকার নয়, পেতলকে সোনা ভাবা অহংকার।

একজন এসে বলল, গোঁসাই প্রসাদ দেওয়া হয়েছে। আসুন।

 

=========

 

আমাদের বসার জায়গার সামনে আরো কয়েকজনের কয়েকটা পাতা দেখলাম।

গোঁসাই বলল, আমাদের অতিথি। বৃষ্টিতে কয়েকঘর মানুষের খুব অসুবিধা। রান্নার জায়গা নেই। তাই বলেছি দু'বেলা এখানে এসে প্রসাদ পেয়ে যেতে।

তারা এসে বসল। খেয়াল করলাম, কুণ্ঠা নেই কারোর মধ্যে। গোঁসাই দু-একটা কথা বলল বাড়ি ছাওনি দেওয়া নিয়ে।

বৃষ্টি বেড়েছে। আমার সারা শরীর জুড়ে নামছে বিষণ্ণতা। ভীষণ বিষণ্ণতা। একা এসে মন্দিরের চাতালে বসলাম। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কোনো কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। গোঁসাই গান গাইছে। নিজের ঘরে বসে। আজ রাতে ও ঘরেই আমারও থাকার কথা। নদীর উপর বৃষ্টির জলের শব্দ অন্যরকম। পাচ্ছি। কিন্তু কোনো উৎসাহ নেই, উত্তেজনা নেই। কোনো ইচ্ছা নেই, সুখ নেই। কি গভীর এক বিষাদ।

আপনাকে ডাকছেন… আসুন।

ভাবলাম, গোঁসাই ডাকছেন। না। অমলকে অনুসরণ করতে গিয়ে বুঝলাম ও রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অমল এখানেই থাকে। অনাথ। গোঁসাই বলে বাজারে কুড়িয়ে পেয়েছিল।

রান্নাঘরে এক কোণে বসে মোচা ছাড়াচ্ছেন সন্ধ্যা মা। বয়েস ষাটের কাছাকাছি। পাশে হ্যারিকেন রাখা। একটু ঝুঁকে আলোর কাছাকাছি চোখটা আনছেন, মোচা খুব যত্ন করে ছাড়াচ্ছেন।

আমি ঢুকতেই বললেন, আমায় একটু সাহায্য কর তো বাবা… কাল কিছু ভক্ত আসবে কলকাতা থেকে।

আমি বসলাম। অমল চলে গেল।

 

=========

 

সন্ধ্যা মা বললেন, তোর মুখটা অত শুকনো কেন রে? কি হয়েছে?

ভাবলাম বলি, কই কিছু হয়নি তো। বললাম না, বাইরে বৃষ্টির দমক, সামনে অমন সরল দু'জোড়া চোখ.. এমন আন্তরিক প্রশ্ন… চুপ করে থাকলাম।

উনি বললেন, দ্যাখ.. তুই খিচুড়ি চেয়ে নিস.. আজ দেখলাম বড় অন্যমনস্ক.. খাচ্ছিস বটে.. মন নেই… কেন রে?

আমার মাঝে মাঝে কিছু ভালো লাগে না মা। কিচ্ছু না।

সন্ধ্যা মা চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি মাথাটা নীচু করে। সব মনটুকু মোচায় দিয়ে ডুবে যেতে চাইছি।

আমার দাদার এই রোগ ছিল। অকারণে আচমকা মন খারাপ হয়ে যেত। বিয়ের চার বছরের মাথায় গলায় দড়ি দিল। আমি জানতাম ও থাকবে না। তুই ডাক্তার দেখা বাবা… এটা ভালো রোগ নয়…

আমি বললাম, জানি। দেখিয়েছি। বলেছে, আমার রোগ নেই কিছু। আমিও জানি আমার রোগ নেই। আসলে মা কিছু পারছি না। এগোতে পারছি না। দিনের পর দিন যাচ্ছে আমি কিছুরই খেই ধরে রাখতে পারছি না। সব মিথ্যা মনে হয়।

সন্ধ্যা মা হাতের কাজ থামিয়ে বললেন, গোঁসাইকেও?

না, নিজেকে। নিজের সব কিছু ভণ্ডামি মনে হয়। মনে হয় সংসারে তিতা সত্য সহ্য করতে পারব না বলে এই সব মিথ্যা খেলায় নিজেকে ভুলিয়ে রাখছি। ভীষণ স্বার্থপরের মত। তোমরা যা করছ খাঁটি। আমি খাঁটি নই। আমি মতলবী।

তবে তুই যা সহ্য করতে পারবি না মনে হচ্ছে তারই মুখোমুখি হ… কি পারবি না মনে হচ্ছে?

এই এত মৃত্যু, এত দুঃখ, এত অবিচার, এত অন্যায়… তুমি বলো, জগতে ন্যায়বিচার বলে কিছু আছে? আমার তো বিশ্বাস হারিয়েছে গো…

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সন্ধ্যা মা। বললেন, তর্কে যাস না। মনটা ক্ষুণ্ণ, ক্ষুব্ধ থাকবে। জগতের হিসাব কি বুদ্ধিতে করবি? সাদা চোখে যা দেখা যায় ততটুকুই কি আসল রে? বয়েস যত হবে, চোখ যত পাকবে, বুঝবি সব কিছুর মধ্যে একটা নিয়ম আছে, মানে না বুঝলেও একটা ধারা আছে। গোঁসাই বলে, চামড়ার জগতটারে পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণ করে মানুষ আজ এত উন্নত হয়েছে যন্ত্রপাতিতে। বিজ্ঞানে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সুখ নাই। শান্তি নাই। সুখ শান্তি কি আর পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ করে আসে বাপ রে, সে আসে ধৈর্য ধরলে। ধৈর্য ধর, ভালোবাসা আবার আসবে। ভালোবাসা এলে আবার সব ঠিক হবে। এত শুকিয়ে যাসনি রে ভাই।

 

=========

 

রাত অনেক। গোঁসাই ঘুমিয়ে। আমার কি হল জানি না, হঠাৎ ঘুম ভাঙল। বাইরে এলাম, দেখলাম বৃষ্টি ধরে গেছে। চাঁদ উঠেছে। আধখানা চাঁদ। চূর্ণীনদীকে কি অপূর্ব লাগছে! কাদামাটি মাড়িয়ে মাড়িয়ে এলাম তীরে। সব ভালো লাগছে।

দাঁড়ালাম চুপ করে। মন শান্ত। মন তর্ক ছাড়ো, ভিক্ষা করো। দু'হাত বাড়িয়ে দাও। ভালোবাসা নামুক। শিশিরের মত নিঃশব্দে। ধৈর্য প্রদীপে ভালোবাসার শিখা। মনে মনে সন্ধ্যা মাকে প্রণাম জানালাম। জীবন যে শিক্ষা দেয়, সজীব হৃদয় যে শিক্ষা দেয়, বই-পাণ্ডিত্য সে দেয় না। শুষ্ক তর্কে জীবন যায় খালি। ফাঁসের পর ফাঁস। রামকৃষ্ণদেব তাই হয় তো বলতেন, গ্রন্থ তো নয়, গ্রন্থি। কোথাও যেন গোঁসাইয়ের একতারার তারকেও সুরে বেঁধে রেখেছেন সন্ধ্যা মা। ওই রান্নাঘরে বসেই। জীবন বড় বিচিত্র। আরো বিচিত্র নিঃশব্দ, বৈভবহীন, আড়ম্বরহীন ভালোবাসা।

ওগো আমায় বাঁচাও, রক্ষা করো আমায় আমার হাত থেকে। আমার জ্ঞান, মুক্তি, সিদ্ধাই কিচ্ছু চাই না, রান্নাঘরে সন্ধ্যা মায়ের পাশে বসে মোচা ছাড়াবার শক্তিটুকু দিও। আমার ওইতেই হবে যা হওয়ার। সে ছেড়ে যাওয়ার মতিভ্রম যেন না হয়, আসলকে যেন সরলতাতেই চিনি। মাটির কাছাকাছি। মা গো! আমার প্রণাম নিও। তোমার পাশে বসে থাকার শীতল ছাওয়াটুকু দিও। শান্তি, শান্তি, শান্তি...

 

(ছবি: Suman Das)