গোঁসাই, তোমার আবীরে যত রঙ, মনে লাগে না কেন?
গোঁসাই শ্রীমাধবের পায়ের আবীর তুলে আমার কপালে দিল। বলল, রঙ লেগেই আছে। যত ধুবি রঙ তত ফুটবে।
বাইরে কীর্তন চলছে। গৌর জন্মকথা। গৌরাঙ্গ জন্মাচ্ছেন। বসন্ত পূর্ণিমাতে। চাঁদ মধ্যগগনে। দুটো চাঁদ সেদিন জগতে। এক শচীমায়ের ঘরে। আরেক আকাশে। কীর্তনীয়া গাইছে।
পুবীর মা চোখ বন্ধ করে বসে। বন্ধ চোখের পাতা ঠেলে জলের ধারা নামছে গাল বেয়ে। যেন পাহাড়ি নদী। পুবী মারা গেছে মাস চারেক আগে। গলায় দড়ি দিয়েছে। ভালোবাসার মানুষ ঠকিয়েছে তাকে। পুবী মেনে নিতে পারেনি। পুবীর মা মেনেছে। একা থাকা ভীষণ কষ্ট। সবাই চায় তাকে ঘিরে এক ভালোবাসার মানুষ থাকুক। সব দুঃখ-কষ্টে তাকে ছায়ার মত ঘিরে থাকুক। পায় না। পুবীর মা একা থাকে। তার স্বামী কোথায় থাকে কার সঙ্গে কেউ জানে না। অনেকে বলে মরে গেছে।
গৌরের জন্মকথায় কাঁদো কেন পুবীর মা? তোমার কোলে তো জন্মায়নি গৌর। তোমার ঘর আলো করে তো আসেনি গৌর। তুমি কাঁদো কেন?
পুবীর মা বলে, শুধু বাইরেটাই দেখলে গোঁসাই? সেতো শুধু অন্ধকার। ভুল বলোনি। কিন্তু আমার মনের ভিতরে কী একেবারেই তাকাতে নেই? দেখো সেখানে আলো করে আমার গৌর জন্মেছে। এ জগতের হিসাব আমি বুঝি, না তুমি বোঝো গোঁসাই? যে বোঝে, সে বোঝাবার দায় নেয় না, তাই তোমার এত অভিমান। কিন্তু তুমি বিশ্বাস যদি রাখো তবে ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে। চোখের জলের মধ্যে দিয়ে যেদিন জ্ঞানের অভিমান ধুয়ে যাবে সেদিন বুঝবে সব। বুঝবে এতদিন কিছুই বোঝোনি।
=====
কীর্তন শেষ হল। আজ দুপুরে এখানে প্রসাদের ব্যবস্থা। আমি গোঁসাইকে বললাম, আজ আমি এখানে প্রসাদ পেয়েই যাব। সন্ধ্যেতে ফিরব।
গোঁসাই বলল, এখানে না গো। আজ তুমি প্রসাদ পাবে পুবীর মায়ের বাড়ি।
আমি অবাক হলাম। বললাম, কেন গোঁসাই? আজ কি পুবীর মা এখানে প্রসাদ পাবে না?
গোঁসাই বলল, না। ওর কাল অশৌচ চলছে। আমি মানি না। কিন্তু গ্রামের আর পাঁচজনের কথা ভেবে পুবীর মা বলেছে ও বাড়িতেই গোবিন্দকে নিবেদন করে প্রসাদ পাবে। আমি বলেছি তুমিও পাবে। পুবীর মা ইতস্তত করেছিল। তুমি পুরুষ বলে না, তুমি শিক্ষিত, শহুরে, ওর থেকে অবস্থাপন্ন বলে। তোমার আপত্তি নেই তো?
আমি জানি শেষের প্রশ্নটা আমাকে উত্যক্ত করার জন্য। কিছুটা অস্বস্তি হলেও বললাম, বেশ, যাব। আপনি আজ্ঞা করছেন, না বলি কী করে?
গোঁসাই না শোনার ভান করে জানলার দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে সুর ধরল।
=====
টালির ছাউনি। একটাই ঘর। সামনে একফালি বারান্দা। মাটির দেওয়াল। মাটির মেঝে। ঘরটা ছিমছাম, পরিষ্কার। ঘরে একটা চৌকি পাতা। পাশে আলনা। কিছু জামাকাপড় সেখানে। খাটের উল্টোদিকে একটা সিংহাসন। ছোটো মতো সিংহাসন। সিংহাসনের উপরে একটা কাঠের আরো ছোটো সিংহাসনের ওপর নারায়ণ শিলা। চন্দন দিয়ে সুন্দর সাজানো।
পুবীর মা আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল, আমার শ্বশুর মশায়ের।
আমি মেঝেতে বসলাম। পুবীর মা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে বলল, একি করছেন… খাটে বসুন…. বাবা যে কী করেন না… আপনার মত মানুষকে পাঠালেন আমার মত অভাগীর বাড়ি…. তাই কি হয়! বাবার কথা ফেলতেও পারি না। আপনার ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়… আর আমিই বা কী বোকার মত প্রশ্ন করছি… হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
আমি বললাম, আমার একটুও অসুবিধা হচ্ছে না দিদি। আপনি বসুন। আমি মেঝেতেই বসি। বাড়িতেও তাই বসি।
মিথ্যা বললাম। আসলে বাইরে থেকে আসছি। এত পরিষ্কার বিছানা। এমনিতে আমার খাটে বসার অভ্যাস নেই। কিন্তু বাড়িতে একটা চেয়ারও নেই।
পুবীর মা মেঝেতেই বসল। দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, কোনোদিন আশ্রমে যেতাম না জানেন। অথচ কী এমন দূর বলুন? যেতাম না। যাওয়ার কথাটা মনেই আসেনি কোনোদিন। গোঁসাই ভিক্ষা চাইতে এসেছেন। বলতে লজ্জা নেই, আর পাঁচজন ভিখারির মত গোঁসাইকেও মনে করেছি, ভিক্ষা দিয়েছি।
পুবীর মা থামল। বলল, আপনি আজ এখানে প্রসাদ পাবেন জেনে আমি একটু চা পাতা কিনে এনেছি। এখন খাবেন? আসলে আমার তো ওসব পাট নেই। আপনি যদি বলেন….
আমি বললাম, বেশ তো। আজকে আমার সঙ্গে আপনিও না হয় খেলেন একটু।
পুবীর মা হেসে বলল, আসুন।
=====
আমি বারান্দার সামনে দরজার কাছে বসলাম। পুবীর মা স্টোভ জ্বেলে চায়ের জল চাপাল।
আমি বললাম, তারপর?
পুবীর মা বলল, ও হ্যাঁ। এর মধ্যে আমার মেয়েটা….
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, জানি। গোঁসাইয়ের মুখেই শুনেছি।
পুবীর মা ঈষৎ হেসে বলল, ভাবছেন মেয়ের মরার খবরটা বলতে এ অভাগীর বুকটা আবার পুড়বে? পুড়বে না। এক বুক ক'বার পোড়ে?
আমি কয়েক সপ্তাহ পাগলের মত করলাম। বাড়ি থেকে বেরোই না। সেলাইয়ের কাজ করি আমি, কোনো অর্ডার নিই না। সবাই বোঝায়, আমার বিরক্ত লাগে। এইভাবে চলছিল।
একদিন কী মনে হল, সেলাইয়ের কিছু জমানো কাজ নিয়ে বসলাম। হ্যারিকেনটা জ্বালালাম। ছুঁচে সুতো পরিয়ে সেলাই করতে বসলাম। হঠাৎ দেখি একটা বড় পোকা, কী করে হ্যারিকেনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে কে জানে…. ছটফট করে আগুনে পুড়ে মরল।
বিশ্বাস করুন, আমি যেন স্পষ্ট নিজেকে দেখলাম। আমিও তো একই কাজ করছি! নিজেকে পুড়িয়ে মারছি… কিন্তু কী করব আমি? সারারাত জেগে বসে কাটালাম। ভোর তখন চারটে। আশ্রমে আরতি শুরু হল। আমি ওই অন্ধকারে খালি পায়ে প্রায় হুঁশবোধ হারিয়ে আশ্রমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা খুলে মন্দিরের সামনে দাঁড়ালাম। শ্রীগোবিন্দ আমার দিকে তাকিয়ে। আশ্রমের সবাই কীর্তনে বিভোর। আমাকে কেউ খেয়াল করেনি। গোঁসাই খেয়াল করলেন। গাইতে গাইতে এসে আমার হাতে একটা খঞ্জনি দিয়ে ইশারায় বললেন, বাজাও।
জানেন, সব বদলে গেল। ওই ভোরের আলোয় গোঁসাইয়ের আমার মুখের দিকে অমন করুণ চোখের আলো যখন এসে পড়ল, সে যেন ভোরের আলোর থেকেও নরম। আমার সব বদলে গেল। আমিই যেন বদলে গেলাম। ওরা তুলসীমঞ্চ প্রদক্ষিণ করতে করতে, নাচতে নাচতে গাইছে। আমি স্থির দাঁড়িয়ে খঞ্জনি বাজিয়ে যাচ্ছি। কে যেন আমায় ধাক্কা দিল, বলল, ওরে ঘোর… নইলে ঘোর কাটবে কী করে? আমায় ঘিরে ঘোর, তবেই আমায় ছাড়া ঘোর কাটবে।
আমার সব হারিয়ে গেল জানেন সেদিন। সব...
=====
দুপুরের প্রসাদ পাওয়া শেষ। ভাত, ডাল, আলুভাজা, শাক, আর এঁচোড়ের তরকারি। সত্যি বলতে এমন সুস্বাদু রান্না কবে খেয়েছি মনে পড়ে না।
প্রসাদ পাওয়ার পর আমি আবার বারান্দায় এসে বসলাম। পুবীর মা এসে বসল কিছুক্ষণ পরেই।
আমি বললাম, গোঁসাইয়ের কাছে রোজ যান?
পুবীর মা বলল, না দাদা। ইচ্ছা করেই যাই না। গোঁসাই বারণ করে। বলে নিজের উঠান নিকা রোজ বৃন্দে… রোজ নিকানো চাই….
আপনার নাম, বৃন্দে?
পুবীর মা হেসে বলল, না, পার্বতী। উনি দিয়েছেন ও নাম।
বললাম, শান্তি পেয়েছেন?
পুবীর মা বলল, ছি ছি…. শান্তি চাইব কেন গোঁসাই? সেকী ভালোবাসার চাওয়া? সংসারে মানুষ নিজের লোকের কাছে কী শান্তি চায় গোঁসাই? চায় মমত্ব। মমতা। নিজের বলে বোধ। সে কী অশান্তিতে না পুড়ে হয় গোঁসাই? তাই গোঁসাই আমাকে খুব পুড়ালেন। এখনও পুড়াচ্ছেন। তবে এখন জ্বালা কম, আনন্দ বেশি।
বললাম, সংশয় হয় না?
পুবীর মা বলল, সংশয়ীই নেই আর… কে করবে সংশয়? যে আছে সে দাস।
বললাম, এই নারায়ণ শিলায় মেটে শূন্য হৃদয়ের আশ? অনেকে বলে যে সে পরমের নাকি রূপ হয় না….
পুবীর মা বলল, সে পরমের ঐশ্বর্যর দিকে যারা তাকায়, তারাই বলে তার রূপ হয় না, মানুষে তার পুজা হয় না। কিন্তু যে মাধুর্যের দিকে তাকায়, সে জানে হয়। একটা সাদা কাগজে দুটো দাগ টেনে শিশু যখন বলে, এই আমার মা, এই আমার বাবা, তখন সে বাবা মায়ের ঐশ্বর্যর দিকে তাকিয়ে বলে না, বলে মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে…. সে পাথরেও আসে…. এ সব গোঁসাইয়ের কথা….
বললাম, আপনি ভাগ্যবান। আমার মনে অনেক আগল।
পুবীর মা বলল, আমারও ছিল। বড় আঘাতে বড় পাঁচিল ভেঙে গেল। আমাদের এখানে একটা বড় বটগাছ ছিল। ঝড়ে উপড়ালো যখন এক মানুষ গর্ত হল। সেই গর্তে জল জমে ওই ডোবা। লোকে বলে বট ডোবা। ওই জলে যখন চাঁদের আলো এসে পড়বে রাতে, আসবেন, দেখবেন শূন্যের ভয়ের চাইতে বড় শূন্য আর কিছু নেই।
=====
আশ্রমে ফিরলাম। বিকেলে আবীর দিয়ে সাজানো শ্রীবিগ্রহ। পুবীর মা-ও তার নারায়ণ শিলাকে আঁচলে আড়াল করে এনেছে। রাখা হয়েছে শ্রীবিগ্রহের সামনে। গোঁসাই আবীর দিল শিলায়। আমার হাতে আবীর দিয়ে বলল, নারায়ণকে দাও, তোমার সব সংশয়, সব ক্ষোভ, সব অভিমান মিশিয়ে দিয়ে দাও নারায়ণের গায়ে। রাঙাও দেখি তাকে? দেখি সে রাঙায়, না তুমি?
আমার হাতে গোঁসাই লাল আবীর দিল। আমি এক পা, এক পা করে শিলার দিকে এগোচ্ছি। বাইরে নামসঙ্কীর্তন চলছে। খোলের আওয়াজ আমার বুকে এসে বাড়ি দিচ্ছে। নারায়ণের কাছে সব ক্ষোভ, সব ভয়, সব অভিমান নিয়ে আবীর দেব আজ… সব… রাঙাব নারায়ণকে আমার ক্ষুদ্রস্বার্থের রঙে…. আমি জিতব… সে হারবে…
কী হল! বুকের কোল থেকে কে হাত বাড়িয়ে সব আবীরের রঙ বদলে দিয়ে গেল। আবীরে মিশল প্রেম…. প্রেম না, প্রেমের আকাঙ্ক্ষা। আমাকে দাসত্ব দাও প্রভু…. দাসত্ব দাও…. আমি তাকালাম পুবীর মায়ের পায়ের দিকে… কাতর হয়ে প্রার্থনা করলাম, আমায় বাঁচাও গো, আমায় রক্ষা করো… আমার অনেক অনেক অভিমান…. গর্ব…. সব নিয়ে নাও… আমায় বাঁচাও…. তোমায় করুণার চোখে দেখছিলাম… যে আমি তোমার করুণার ভিখারি…..
রাত হল। আমি ফিরব। সেই ডোবার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
পুবীর মা বলল, কী জানেন গোঁসাই…. শোক, দুঃখ কিছু কি ছেড়ে যায়? সব থাকে। আমারও আছে। কিন্তু তারা আমার গৌরসুন্দরের আসার রাস্তাটা আটকে দাঁড়ায় না। তার আসার পথ করে দেয়।