ঠাকুর মাকে দর্শন করলেন। এ বড় কথা না। এ যাবৎ কত অমন দ্রষ্টা নারীপুরুষকে দেখলাম। তাদের রকমসকম দেখে পালালামও। কিন্তু ঠাকুরের চিত্ত মা হয়ে উঠল, এ এক আশ্চর্য কথা। খাঁড়া নিয়ে না, মুণ্ডমালা নিয়ে না। মায়ের মনের কথাটা বুঝলেন। বললেনও। আগে কেউ এমনটি করে বলেননি। আগে যুক্তি দিয়ে অনেকেই বলেছেন। কিন্তু এমন মা হয়ে কেউ বলেননি। কী সে কথা?
ঠাকুর বলছেন, মা বাড়িতে মাছ এনেছে। কিন্তু সবার পেটে তো এক রেসিপি চলবে না। তাই মা পেটের সহনশীলতা অনুযায়ী আলাদা আলাদা পদ রাঁধলেন। কারোরটা বেশি স্পাইসি, কারোরটা একদম ট্যালটেলে ঝোল।
উপনিষদ এর আগে বলেছিলেন, এক সত্য বহু হয়েছেন রুচি ভেদে। এ তত্ত্ব কথা। ঠাকুর বলছেন, পেটের সহ্যক্ষমতা ভেদে।
আগে এক যুগ ছিল, যাকে বলা হয়েছিল “এজ অব রিজিন”। এখন এক যুগ চলছে, “এজ অব অ্যাজেন্ডা”। এখন কেউ ভালোবেসে কোনো কিছু করার কথা বলে না। এখন সবই অ্যাজেন্ডা ভিত্তিক। ভালোবাসাও অ্যাজেণ্ডা। কেমন? না ওতে আপনার ব্লাড প্রেশার ভালো থাকবে, ঘুম ভালো হবে, গুড উইল তৈরি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। খাওয়াদাওয়া, শোয়াবসা, ঘুরতে যাওয়াও এখন অ্যাজেণ্ডা। কেমন? না এমনভাবে সব করতে হবে যেন অসুস্থ না হই। অর্থাৎ সদাসর্বদা সুস্থ থাকার অ্যাজেণ্ডা। এটা কি খারাপ? একদমই না। কিন্তু অতিরিক্ত কোনো কিছুরই যেমন ভালো না, এই ক্ষেত্রেও না। ভালো থাকার “ট্র্যাপে” পড়ে একবেলা দুটো আলু খেয়ে ফেলেছি বলে যদি চারবেলা উৎকণ্ঠায় কাটাতে হয়, তবে ঝাঁটা মারি অমন ভালো থাকায়।
এখন বিজ্ঞাপনের যুগ। মুখ শুধু না, গোটা শরীর ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপন মানেই অ্যাজেণ্ডা। এর মধ্যে সব চাইতে চতুর ট্রিকস হচ্ছে, আমাকে ভালো রাখার অ্যাজেণ্ডা। শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন থেকে হেলথ পলিসি, মনোবিজ্ঞানের নানা সুতীক্ষ্ম আলোচনা থেকে চার ইঞ্চি না মাইল কী যেন একটা কেটে বাইপাস করে আমাকে ভালো রাখার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই আমার ভালো চায়। বিশ্বসংসারে সবই প্রায় কল্যাণময়ী মায়ের ছদ্মবেশে কী যে অ্যাজেণ্ডা নিয়ে ঘুরছে সে তারাই জানে।
কিন্তু কেউ এই খাঁটি কথাটা বলে না, সদাসর্বদা ভালো থাকার ইচ্ছাটা একটা ব্যামো। ঠাকুরের তো কোনো অ্যাজেণ্ডা নেই। এমনকি আমাকে আস্তিক বানানোরই চাপ নেই। কোনোদিন বলেননি কালীঘরে না গেলে শাপ লাগবে, ঈশ্বরকে না মানলে মহা অনর্থ হবে। শুধু বলেছেন, যা পেটে সহ্য হচ্ছে বাবা, সেটাই করো। জানো ওটাই তোমার জন্য ব্যবস্থা। রুচি বড় কনফিউশানজনক কথা। কীসে যে রুচি, কোনটা যে আমার সত্যিকারের রুচি আর কোনটা যে আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া ভাপিয়ে ওঠা রুচি, কে বলবে? কিন্তু যার পেটে চিংড়ি সহ্য হয় না, তাকে যেমন ছলেবলে কৌশলে যা করেই হোক চিংড়ি খাওয়ালেই তার শরীরের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবেই হবে, এও তেমন। অগত্যা যা সহ্য হয় না, গিলে মোরো না। সোজা কথা।
ভালো থাকার পাসওয়ার্ড। ভালো থাকার কৌশল। ভালো থাকার অভ্যাস। উফ উফ উফ। দরকার নেই। এগুলোতে রাতদিন অবসেসড হয়ে যাওয়াটা আদৌ ভালো হচ্ছে? সু অভ্যাস ভালো। পরিমিত নিয়ন্ত্রিত জীবন ভালো। কিন্তু অবসেসড জীবন? ভালো না। কোনো কিছুতেই অবসেসড জীবন ভালো না। কিন্তু অ্যাজেন্ডাকে ঘাড়ে করে নিয়ে বেড়ালে ক্রমশ সেই অ্যাজেন্ডা কখন যে অবসেসানে পৌঁছে যায় বলা শক্ত।
এর থেকে বেরোনোর উপায় স্বামীজি একটা বাতলেছেন। উনি পাওহারি বাবার কাছে শুনেছিলেন। কথাটা হল, “যন সাধন, তন সিদ্ধি”। যাই সাধন, তাই সিদ্ধি। বেশ কিছু ক্ষেত্রে কথাটা বেশ জরুরি। যে কাজটা করছি সে কাজটাকে ভালোবেসেই যদি করি, তবে সেই কাজের মধ্যেই একটা পরিপূর্ণতা আছে। সার্থকতা আছে। উদ্দেশ্য আর উপায়ে অন্তর থাকল না আর। দুই-ই একাকার। আমি যদি ঈশ্বরের নাম করছি, তবে সে রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায়, “তোমারই নাম বলব, নাম বলব নানা ছলে…বলব বিনা ভাষায়..বলব বিনা আশায়…..শিশু যেমন মাকে, নামের নেশায় ডাকে”।
আরেকবার ঠাকুরের সামনে এসে দাঁড়ানো যাক। খুঁজি তার এত কিছুর মধ্যে অ্যাজেন্ডাটা কী ছিল?
নামযশ চাই?
না। কেশব কাগজে ছাপিয়েছিল বলে বকা খেয়েছিল।
টাকাপয়সা?
না। একজন জমিজায়গা লিখে দিতে এসে বাঁশের তাড়া খেয়েছিল।
সিদ্ধি? দিব্যজ্ঞান?
“হাতের ব্যামোই সারাতে পারছি না, আবার মানুষ মোলে কী হয়?”....ওঁরই উক্তি। তখন ওঁর হাত ভেঙেছে, আর একজন ওইসব প্রশ্ন করেছেন।
দল-টল খোলা?
“ওসব গেঁড়িগুগলি ডোবায় থাকে, সাগরে না।”
তবে চাও কী?
“খাইদাই, মায়ের নাম করি, মা সব জানেন।”
এই যে এত লোকের দুয়ারে যাও যেচে, এই যে এত লোকের জন্য গামছা নিংড়ানো অপেক্ষা? কীসের জন্য?
“লোক কই রে? আমি সব মা দেখি।”
অ্যাজেণ্ডা নেই। আমাকে সুখে রাখার বিজ্ঞাপন নেই। আমাকে ভালো রাখার, সুস্থ রাখার দাবী নেই। যদি যাই তবে কী হবে? কী পাব?
শান্তি। আনন্দ। ভালোবাসা। দিনদুনিয়ার উপর ভালোবাসা কমে গেলে আবার দুই হাত পেতে ভিক্ষা নেওয়ার মত করে আবার ভরে নেওয়া। যতবার চাও। শূন্য ফেরায় না। গলায় ক্যান্সার নিয়েও ফেরায়নি সেদিন।
শেষ কথা। অ্যাজেন্ডা কি খারাপ? না। শুধুই অ্যাজেন্ডা নিয়ে বাঁচা খারাপ। অ্যাজেন্ডা ফুরিয়ে গেলে জীবন শুধুই ভ্যারেণ্ডা।