7ই অগাস্ট থেকে আজ 9ই সেপ্টেম্বর, বাবাকে নিয়ে ফিরলাম BR SING হাস্পাতাল থেকে। মাঝে অগাস্টের শেষের ক'দিন চলল যমে মানুষে টানাটানি, প্রায় দশ/বারোদিন।
যে কথাটা বলার। বিশেষ করে বলার। প্রথমত বি আর সিং হাস্পাতালের ICU -র ডাক্তারদের অসম্ভব ধৈর্য্য আর বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার। প্রতিদিন সকাল বিকাল ডাক্তারের সাথে দেখা করার সময়। সামনে বসিয়ে, বুঝিয়ে, ঝুঁকির কথা বলে, বিপদসীমার কতটা উঁচুতে চলছে শ্বাস-প্রশ্বাস বুঝিয়ে, তবু ধৈর্য্য ধরতে বলতেন। মাঝে একটা সময় আমরা আশাই ত্যাগ করেছিলাম প্রায়। তবু মির্যাকেলের মত সেপ্টিসিমিয়া ওনারা নিয়ন্ত্রণে আনলেন। বললেন, ওনাকে বাড়ি পাঠাতে পারলে আমাদের চেয়ে খুশী কেউ হবেন না। পারলেনও। তবে মাঝের দিকে ওনাদের অসহায়তাও চোখে পড়ার মত। তবু হার মানতে মানা, এমনভাবেই লড়াইটা চলল।
যে খারাপ অভিজ্ঞতা গতবার BR SINGH MEDICAL -এ হয়েছিল, প্রায় বিনা চিকিৎসায়, রোগের হদিস না পেয়ে ফিরতে হয়েছিল। এ যাত্রায় সে ক্ষোভ রইল না। সার্জিকাল আর ICU ততটাই সিরিয়াস আর বন্ধুত্বপূর্ণ।
এক মা-মেয়েকে রোজ দেখতাম। ভদ্রমহিলার স্বামীর সংকটজনক অবস্থা। সারাদিন তারা মা মেয়ে ICU -এর সামনে বসে কাটাচ্ছেন। হনুমান চালিসা, মহামৃত্যুঞ্জয়, আরো নানান স্তবস্তোত্র সাশ্রুনয়নে পড়ে যাচ্ছেন। ICU -র দরজায় মাথা কুটছেন। আঁচল দিয়ে দরজার উপরের সব অমঙ্গল মুছে দিচ্ছেন। খালি পায়ে পায়চারি করছেন আর গাইছেন। জানি না এখন তিনি কেমন আছেন। তবে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা যখন দেখতাম কলকাতার আকাশে সিঁদুরে মেঘে সন্ধ্যে নামছে, পাখিগুলো এত দূষণের মধ্যেও পথ খুঁজে নীড়ে ফিরছে, অজস্র মানুষ সারাদিনের রুজিরোজগার সেরে ট্রেন ধরার জন্য শশব্যস্ত হয়ে শিয়ালদহ স্টেশানের বড় বাড়িটায় মিলিয়ে যাচ্ছে... মনটা হঠাৎ ভীষণ একলা হয়ে এই অসীম সংসারটার, অনাদি জীবনস্রোতটার পাশে এসে দাঁড়াত। যেন কুম্ভস্নানে এসেছি। পরম পবিত্র রক্তের দুর্নিবার স্রোতের সামনে কোনো পাপ চিরস্থায়ী হতে পারে না। তাই অবশেষে সবার সবাইকেই প্রয়োজন। আর সবাই মানেই তো তিনি, যিনি সর্বতঃ পাণিপাদং, সৰ্বতোহক্ষিশিরোমুখম্... যাঁর হাত-পা-মুখ-চোখ সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি... সবাইকে ঘিরে অবস্থান করছেন। সে কে? সে সেই যাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না, আত্ম-সংজ্ঞায় অনুভব করা যায়। সে মহৎ।
বন্ধুদের কথা আর নতুন করে কি বলার। এমন একটা পদক্ষেপও নিতে হয়নি যার পাশে তাদের কাউকে না কাউকে পাইনি। আমার প্রতিদিনের আশেপাশে তারা তো থাকেই। আর তোদের তো আমায় ঘাটে না নিয়ে যাওয়া অবধি শান্তি নেই।
তবে বিশেষ করে উল্লেখ করার Sukanya Bandyopadhyay এর অসম্ভব উপস্থিতি। তবে এ সব বলা মানে যেন কোথাও কৃতজ্ঞতার দায়মুক্ত হতে চাওয়া। তাই এ প্রসঙ্গ এখানেই থাক।
দাদা, দিদি, কাকু, বোন, ভগ্নীপতি... এদের মধ্যে আমাদের বিশাল নির্ভরতার স্থান দাদা Subrata Chakraborty যদিও জামাইবাবু, তবু রক্তের সম্পর্কের দাদার চাইতে কম কিছু নয়! ঢালের মত দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা রাখে মানুষটা।
এর সাথে আরো অনেক কথা বলার, রাতের কলকাতা, সকালের কলকাতা, দুপুরের কলকাতা... কত গল্প... কত কবিতা কোন বিশ্বকবির হাতে এই লেখা হচ্ছে, এই মিলিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা লাইন চোখে পড়তে না পড়তেই পরের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে। কিছু ধরা থাকল। আর যা মিলিয়ে গেল তাও ধরা থাকল কালের খাতায়, কোনো মহাকবির কলমে জেগে ওঠার অপেক্ষায়। অজস্র চোখের অজস্র কথা... অকারণ নিজের দুঃখে বুঁদ হয়ে সময় কাটানো নিতান্তই মিথ্যা... অপচয়।
জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে আপনার? ভদ্রলোকের বয়েস ষাট পেরিয়েছে সদ্য। বললেন, প্রস্টেট ক্যানসার। মুখের দিকে তাকালাম। সৌম্যকান্তি, সুঠামদেহ, উজ্জ্বল দুটো চোখ - এমন মারণ রোগ নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন! বাবার পাশের বেডেই থাকেন। বললাম, আচ্ছা, তবে চিকিৎসা এখন অনেক উন্নত তো... নিজের কানেই নিজের কেমন মিথ্যা মিথ্যা লাগল। তবু কথাটা শেষ করলাম। ওনার চোখে জল। বললেন, মনের জোর পাচ্ছি না জানেন। জলে ভরে এলো দুটো চোখ।
আমার অসম্ভব রাগ হল। মনে হল, এমনি এমনি মানুষটা মরে যাবে? না, যেতে দেব না। আমিই দেব না। কিছুতেই দেব না। বললাম, যতই আপনার ক্যান্সার হাড় অবধি পৌঁছাক, আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে যাবই আপনাকে তিন বছর পর দেখতে আর চা খেতে, কেমন পালান দেখি।
উনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন। কান্নাটা প্রায় ভেঙে পড়ার মত। তবু একখন্ড হাসি দিয়ে, জোরালো হাসি দিয়ে তাকে আটকে রাখলেন। হ্যাঁ, এটাই চাই। উনি মরবেন না।
গভীর রাতের কলকাতায় অনেক মানুষকে মুখে রঙ মেখে ঘুরতে দেখেছি, রাস্তার ধারে সপরিবারে শুয়ে থাকতে দেখেছি তার চেয়েও বহু মানুষকে। কেউ হেরে যায়নি এরা। হেরে যায়ও না। মানুষ হারকে সাময়িক জানে, চিরকালের জানে না। তাই শবের গাড়ি সাজানো হয় যখন হাস্পাতালের নীচে তখন অপারেশন থিয়েটারে আরেকজন কেঁদে ওঠে... নবজাতকের কান্না... প্রাগৈতিহাসিক কান্না...