সৌরভ ভট্টাচার্য
31 March 2018
মুরাকামির লেখায় যৌনতা, দর্শন আর সঙ্গীত পাশাপাশি হাঁটে। তার সাথে কিছু অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাবলী। টানটান গল্পের বুনোট। ঝরঝরে ভাষা। উপমাগুলো দৈনন্দিন জীবনের অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া।
1Q84
=======
থ্রিলার, ম্যাজিক রিয়েলিটি ইত্যাদি কোন ছাঁদ বলা শক্ত। তবে মাত্র তিনটে গোটা চরিত্র আর কয়েকটা টুকরো চরিত্র নিয়ে যে এমন হাজার তিনশো পাতার বই লেখা যায়, তা বিস্ময়কর। যাদের যৌনগন্ধে গা গুলায় তাদের না পড়াই ভালো। জাত যাবে। মনের শুদ্ধতা নষ্ট হবে। হাজার হোক আমরা আবার চারিত্রিক শুদ্ধতায় বিশ্বাসী। যে চারিত্রিক শুদ্ধতা সততায় না, ব্রহ্মচর্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মুরাকামি রেহাই দেবে না। নিখুঁত যৌনতার বর্ণনায় মানসিক ও শারীরিক স্থিরতা নষ্ট করতে পারেন।
পাশ্চাত্য সংগীতের কিছুটা জ্ঞান, পাশ্চাত্য দর্শনের কিছুটা বোধ আর বিশ্বের ক্লাসিকগুলোর কিছুটা আভাস না থাকলে মাঝে মাঝেই ধোঁয়াশা লাগবে। তবে অসুবিধা হবে না। কারণ মুরাকামি কিছুটা উল্লেখ করে দেবেন। যেমন Animal Farm, Brothers Karamazove ইত্যাদির প্রসঙ্গ আসবে।
গল্পের প্রেক্ষাপট একজন উদীয়মান লেখক আর একজন সদর্থে পুরুষ হত্যাকারিনীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। যারা ঘটনাচক্রে প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকা, কিন্তু বর্তমানে বিচ্ছিন্ন। মাঝে চলে আসে রামরহিম বাবার মত একটা সংগঠন। যার সাথে এরা জড়িয়ে পড়ে। তারপর নানা প্রাকৃত, অতিপ্রাকৃত ঘটনার মাধ্যমে তারা দু'জন পরস্পরকে খুঁজে পায় গল্পের একদম শেষে।
একজন সার্থক ঔপন্যাসিকের মত অসম্ভব সুন্দর গল্পের জাল বুনতে পারেন মুরাকামি। এ গলি সে গলি দিয়ে ঘুরিয়ে পাঠককে একটা বড় মাঠে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করান। যাকে আমরা প্রধান ক্লাইম্যাক্স বলতে পারি। তার আগে অসংখ্য দমবন্ধ করা মুহূর্ত, পলে পলে চমক বইটার পাতায় পাতায়।
Kafka On The Shore
=================
এই বইটা মুগ্ধ করল। অস্বস্তিতে ফেলল। ভাবালো। একটা পনেরো বছরের ছেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। মানে পালিয়ে যায়। যে অভিশপ্ত তার বিখ্যাত স্থাপত্যকার বাবার কাছে থেকে - যে সে তার মা আর দিদি, যারা তাকে ছোটোবেলায় ছেড়ে গেছে তাদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হবে আর পিতৃহন্তা হবে। নিয়তি ছেলেটাকে দিয়ে তাই তাই করায় অজান্তে।
তবে ঘটনা তা নয়। সে-ই যেন মূল উপপাদ্য নয়। মূল উপপাদ্য নিজেকে খোঁজা। চিত্তের গভীরে গিয়ে আত্মার হাজার ওয়াটের বাল্ব দেখা নয়। নিজের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য বিভিন্ন ঘটনা, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেগুলোর মধ্যে দিয়েই হেঁটে পথ বার করা।
মূল চরিত্র, তার নিজেকে খুঁজতে হবে এই অভিশাপের মধ্যে দিয়েই, যে অভিশাপের বাস্তবায়ন অবশ্যম্ভাবী।
একজন মানুষ যে সম্পূর্ণ না, তার ছায়া সাধারণ মানুষের থেকে অর্ধেক গাঢ়, যার বিচার পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে intuition নির্ভর বা impulse নির্ভর। সে চরিত্রে অত্যন্ত সরল, দরদী, পরোপকারি। যে পড়তে লিখতেও পারে না। তাকে নিজেকে খুঁজতে হবে, নিজের ছায়ার বাকিটা।
একজন যৌন পরিচয়ে জটিল। সে শারীরিক ভাবে মহিলা, কিন্তু পুরুষোচিত ব্যবহার ও অন্তঃকরণ এবং পুরুষেই যৌনতার আকর্ষণ বোধ করে। তার সাথে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের কথোপকথনগুলো আকর্ষণীয়। দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, জীবনবোধ - অদ্ভুত সুন্দরভাবে, মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপিত মুরাকামির অসামান্য স্বচ্ছ ভাষায়।
এরকম আরো চরিত্রেরা আছে, যারা নিয়তি আর আত্মবোধের মধ্যখানে সময়কে ধরে ধরে এগিয়ে জীবনের নানা বাঁকে নানা অভিজ্ঞতায় একটা রূপরেখা তৈরি হতে দেখছে নিজেদের জীবনের।
মুরাকামির জীবনকে দেখার আঙ্গিক খুব মৌলিক। মৌলিকতার একটা মুশকিল হল, অনেক সময় সেটা পূর্ববর্তীর প্রতি উন্নাসিক হয়। মুরাকামি তা নয়। পৃথিবীতে আজ অবধি যত মৌলিক চিন্তা মানুষের জীবন নিয়ে হয়েছে প্রধান ধারায়, মুরাকামি সে সম্বন্ধে সশ্রদ্ধভাবে ওয়াকিবহাল। তার চাইতে বড় কথা বিভিন্ন আপাতবিরোধী চিন্তা বা দর্শনের মধ্যে একটা যোগসূত্র খোঁজার তাগিদ মুরাকামির লেখায় প্রবল। তবু শুষ্ক দার্শনিক আলোচনা হয়ে দাঁড়ায় না। চরিত্রগুলো ভীষণ জীবন্ত হয়ে সারাক্ষণ লেখার মধ্যে একটা সজীবতা নিয়ে আসে। আর অবশ্য উল্লেখ্য, মুরাকামির রূপক ব্যবহারের কৌশল।
প্রতিটা সময়ের একটা খোঁজ থাকে। সে খোঁজে খুব সাহসী মুরাকামি। যদিও কখনও কখনও যৌনতার বিবরণ বেশ কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মনে হয়েছে। মুরাকামি যেন কিছুটা অসহায়। একটি পুরুষ আর নারী পাশাপাশি এলে যৌনদৃশ্য না ঘটিয়ে মুরাকামি পাঠককে রেহাই দেন না। এখন সে রেহাই না আমোদ তা অবশ্যই পাঠকের রুচির উপর নির্ভর করবে। তবে বুদ্ধিবৃত্তি আর চিত্তবৃত্তি - দুয়েরই সমান মাত্রায় তৃপ্তিলাভের উপাদান যথেষ্ট সাহিত্যে কম বলেই, মুরাকামি বেশ আলোড়িত করেই, এ অনস্বীকার্য।
মোদ্দা কথা পড়ার অভিজ্ঞতা ভালো। 'রাজা মশায় বললেন, একবার খনি'টা দেখে যেতে, কত কিছু শেখা যায়... জানা যায়...'
তা পড়ে ফেললে ক্ষতি নাই। পড়া যেতেই পারে।