Skip to main content
 
 
 
টেবিল বুক করে, বারবার ঘড়ি দেখে, আসা-যাওয়া করা মানুষে চোখ রেখে বসে থাকবে, না টেবিলটা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়বে?
       অনেক মানুষকে দেখলাম, একটা টেবিলের পাশে বিষণ্ণতায় সারাটা জীবন কাটিয়ে দিল। কে যেন আসার ছিল। কে যেন কথা বলতে বলতে মাঝপথ থেকে উঠে গেল। কে যেন তার টেবিল ছেড়ে অন্য টেবিলে বসে বেশিক্ষণ সময় কাটালো। কেউ ফিরে এলো অন্য টেবিল থেকে, কিন্তু সেই টেবিলের কাঁটা চামচ নিয়ে, এই টেবিলে রাখতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বারণ করল কেউ, কেউ অভিমানী হল, কেউ আত্মহত্যা করবে বলে হোটেলের ছাদে উঠে গেল। খাদে ঝাঁপ দেওয়ার আগে খেয়ালই করল না তার সামনে জ্যোৎস্নার আলোতে ভেসে যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সে একবার তাকালেই ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছাটা চলে যেতে পারত, তার বুক করে রাখা টেবিলের সমস্ত অভিমান ভেসে যেত। কিন্তু সে ভাবল না। সে ঝাঁপ দিয়ে দিল। তার টেবিল বুক করে তখন অন্য কেউ বসে। সুখী হবে বলে।
       যদি সুখী হতে না চাই? যদি ভাবি এই খোলামেলা পৃথিবীতে শুধু হাঁটব? অনেকের সাথে দেখা হবে, অনেকের সাথে দেখা হবে না, কিন্তু কোনো অপেক্ষা থাকবে না, আক্ষেপও থাকবে না, তবে কেমন হয়? কেউ বলবে নিষ্ঠুর, কেউ বলবে উদাসী, কেউ বলবে ক্ষ্যাপা, কেউ বলবে সন্ন্যাসী। আসলে আমি মনে মনে জানব, আমি আদৌ কিছু নই। আমি শুধুই হাঁটছি। আমার কোথাও পৌঁছানোর নেই। আমার কাউকে খোঁজার নেই – না কোনো তত্ত্ব, না কোনো তালা-চাবি ভালোবাসার। আমার কিচ্ছু জানার নেই। আমার কিচ্ছু শোনার নেই। আমার দু’চোখ মেলে শুধু দেখার আছে, শুধু দেখার...
       রণো আজ আত্মহত্যা করতে পারতো সকালে। করেনি। ইচ্ছা করেই করেনি। আজ সকালে মরতে ইচ্ছা করল না। অথচ এই পাহাড়ে এসেছে আত্মহত্যা করবে বলে। নিছক নিজেকে শেষ করে দিতে হবে বলে। তিস্তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। হোটেলটাও এমন খাদের ধারে, যেন কোনো একদিন এই হোটেলটাও তিস্তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলেই এসেছিল, থমকে দাঁড়িয়ে আছে, তার মত।
       এক কাপ কফি খেয়ে, চেয়ারে গা’টা এলিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে বসে আছে রণো। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না যদিও, মেঘে ঢাকা, এই জুলাই মাসে তাই হয়। পাহাড়ও ফাঁকা ফাঁকাই এখন।
       রণো পাহাড় ভালোবাসে। ঠিক তা নয়, পাহাড় রণোকে আঁকড়ে ধরে। রণো নিজেকে পাহাড়ের কাছে যেভাবে বিকিয়ে দেয়, তেমন কারোর কাছে না, এমনকি কোনো নগ্ন উত্তুঙ্গ ভালোবাসার কাছেও না।
       ভীষণ মাথাটা ধরে আছে। রুমের মধ্যে মাথা ছাড়ানোর আয়োজনও আছে, কালই দুই বোতল কিনে এনেছে – তরল গরল।
       এষা অপেক্ষা করছে। একটা ছোটো টেক্সটের – ডান, ইংরাজিতে আসবে, ডি ও এন ই। মানে হয়ে গেছে। রণো ঝাঁপ দেওয়ার আগের মুহূর্তে লিখে পাঠাবে তাকে। এষা মধ্যমগ্রামের ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে আছে, হাতে ধরা মোবাইলটা, বারবার স্ক্রিণে টোকা মেরে দেখছে, মেসেজটা ঢুকল কিনা। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ পনেরোই জুলাই, আজই রণোর আত্মহত্যা করার দিন। কিন্তু এখনও কেন করছে না? পাহাড়ে কি নেটওয়ার্কের প্রবলেম? ধস নেমে কি নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন?
       এষা উঠে দাঁড়ালো। দেরি করলে তো হবে না। আজকেই মরতে হবে রণোকে, আজকেই। একটা কল করলেই তো বোঝা যায়, এই তো রিং হল। একটা রিং করেই কেটে দিল এষা।
       রণোর মোবাইলটা টেবিলের উপর জ্বলেই নিভে গেল। রণো খেয়াল করেনি। মোবাইলটা সাইলেন্স করা আছে। রণো আনমনা। ওয়েটারের মত মৃত্যু আর এষা অপেক্ষা করছে তার, টেবিলের দু’পাশে দাঁড়িয়ে দু'জনে। দু'জনেই জানতে চাইছে আর কতক্ষণ?
 
 
       এষা একবার ঘরে ঢুকে বিদ্যুতের ঘুমন্ত মুখটা দেখে এলো। সাড়ে ছ'বছর বয়েস। এসিটা অফ করে জানলাটার কাঁচগুলো সরিয়ে পর্দাটা টেনে বাইরে এসে আবার দাঁড়ালো। রণোকে মরতেই হবে। ওর স্বাভাবিক মৃত্যু কোনো নার্সিংহোমে, প্রাইভেট হাস্পাতালে হতে দিতে পারে না এষা। অনেক লড়াই করে তারা এই জায়গায় দাঁড়িয়েছে এসে। সিঙ্গাপুরে অনেক বড় চাকরি করত রণো। ওখানেই এই রোগের সূত্রপাত। ততদিনে এষাও একটা ভালো চাকরি পেয়ে গেছে এই কলকাতায়, সে যেতে চায়নি সিঙ্গাপুরে। এষা নিজেও টেস্ট করিয়েছে, নেগেটিভ। যদিও সম্ভব ছিল না পজিটিভ হওয়ার, বাবু যখন আড়াই বছর তখনই ও চলে যায় সিঙ্গাপুরে।
       রণো নিজের রুমে এলো। মোবাইলটা ব্লিং করছে, নিশ্চয়ই এষা কল করেছিল, থাক। আরেকটু সময় বেঁচে নিতে ইচ্ছা করছে। আরেকটু। তার সাথে সাথেই মারা যাবে বিষাক্ত জীবাণুর দল – এই তিস্তার বুকে ছড়িয়ে যাবে – এইচ আই ভি। তিস্তা এইচ আই ভি পজিটিভ হবে না। পাহাড় হতে দেবে না। পাহাড় তাকে প্রতিদিন নতুন জীবন দেয়, প্রতিদিন নতুন ভালোবাসা। মানুষ পাহাড়ের মত ভালোবাসতে পারে না। পাহাড়ের মত নির্ভয়, নির্লোভ নয় মানুষ। রণো ভাবে, সে এই পাহাড়ের বুকে আবার জন্মাবে। মানুষ হবে না, একটা পাহাড়ি গাছ হবে। তার সারা শরীর জুড়ে কুয়াশা মাখবে, বরফ মাখবে, পাহাড়ি ঝরণার ঝিরিঝিরি জলে গা ভিজবে সারাদিন। পাহাড়ি পাখি এসে তার গায়ে বসবে। চা-পাতা তুলে ক্লান্ত কোনো পাহাড়ি মেয়ে তার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে বিশ্রাম নেবে, পাহাড়ি গান গাইবে। কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকবে রাতদিন সে।
       রণো বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে।
 
       এষা মোবাইলটা নিয়ে বসে। সমাজে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে তার আর রণোর আর কি উপায় ছিল? রণো পাহাড়ে শেষ হয়ে যাবে। মৃত মানুষের রক্তের পরীক্ষা হয়? হয় না তো। নমিনি বাবু। কোম্পানি থেকে মোটা টাকা পাওয়ার কথা। তার নিজেরও যা আয় তাতে বাবুকে ভালোভাবেই মানুষ করতে পারবে, কিন্তু মাথা উঁচু করে বাঁচতে তো হবে! একবার ভেবেছিল কোনো অজগ্রামে গিয়ে থাকে, কিন্তু সেটা রূপকথা, বাস্তবে হয় না।
       এষা আজকে কাজের কাউকে আসতে বারণ করে দিয়েছে। আজ রণোর জন্মদিন – পনেরোই জুলাই। এষা রাঁধবে না আজ। গলা দিয়ে নামবে না। তা ছাড়া আজ থেকে অশৌচ। গতকালই পার্লারে গিয়ে চুলটা ঠিক করিয়ে এসেছে। বড় চুল রাখতে পারে না এষা। পনেরোদিন শ্যাম্পুও করা যাবে না। গতকালই শ্যাম্পুটা করে এসেছে তাই। তবে এবার কণ্ডিশনিংটা ঠিক হয়নি যেন, চুলগুলো কেমন খড়ের মত মনে হচ্ছে। পরেরবার এখানে আর যাওয়া ঠিক হবে না।
       কিন্তু এত দেরি হচ্ছে কেন? একটা কল করবে? না, গলাটা শুনলে দুর্বল হয়ে যাবে। সব ভেস্তে যাবে। এই প্ল্যানটা তারা কত রাত জেগে তবে বানিয়েছে। বারবার নিজেকে স্বার্থপর, অমানুষ মনে হয়েছে এষার। কিন্তু সে তো একটা তকমা। জীবন তকমায় চলে না, টাকা-মান-সম্মান ছাড়া চলবে কি করে? একটা বদনাম, মানুষের ঘেন্না নিয়ে বাঁচা যায়? বাবু কি পরিবেশে মানুষ হবে? কল করতেই হবে। ওকে মনের জোর দিতে হবে। দুর্বল হয়ে গেছে হয় তো। যে কোনো মানুষেরই তাই হবে। এষা নিজেও কি পারত? হয়তো না। এই সময়ে দু'জনেই দুর্বল হলে কি করে হবে, একটা ফোন করতেই হবে। সুইচ অফ! মানে?
       রণো মোবাইলটা অফ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেকদিন শান্তির ঘুম হয় না। আজ কি কি করে যেন মনটা অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেছে। যেন তার সারা শরীরে কোনো রোগ নেই। সে যেন পাহাড়ের শুশ্রূষায় ভালো হয়ে গেছে। মাথাটা শান্ত। তার পাশে যেন বাবু ঘুমিয়ে তাকে জড়িয়ে, তার পেটের উপর একটা পা রেখে।
       ঘুম ভাঙল দুপুর একটায়। প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে। মোবাইলটা অন করল। এষার সতেরোটা মিসড কল। লজ্জা লাগল। এতক্ষণে সত্যিই তো তার মরে যাওয়া উচিৎ ছিল। নিজের পরিবারের জন্য এটুকু করতে পারে না সে?
       রণো একটা গাড়ি ভাড়া করল। শহর থেকে দূরে একটা জায়গায় নেমে পড়ল। এই জায়গাটায় সে মনে মনে অনেকবার এসে দাঁড়িয়েছে। এষার সাথে হনিমুন করতে এসে এখানেই প্রথম প্রকাশ্যে চুমু খায় এষাকে, বিদেশী সিনেমা নকল করে, নিজেকে কেমন বিদেশী নায়কের মত লাগছিল।
       ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার বাঁক এটা একটা। চারদিকে কোনো গাড়ির শব্দ নেই। শুধু পাইনগাছগুলোর মাথায় বৃষ্টির অঝোর ধারা ঝরে পড়ার শব্দ। এবারে কাঞ্চনজঙ্ঘাটা দেখা হল না। এই প্রথমবার। মোবাইলটা হাতে নিল। টেক্সট করল ‘ডান’। কালভার্টটার উপরে এসে দাঁড়ালো। অনেক নীচে তিস্তা। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। তাকে বিদায় জানাচ্ছে। কেন বিদায় জানাচ্ছে? সে তো পাহাড়েই ফিরছে। পাহাড়ের বুকে। এখানেই জন্মাবে আবার।
       টেক্সট যখন এষার মোবাইলে পৌঁছালো তখন এষার দেহটা শীতল। ওড়নাটা টানটান হয়ে আছে পাখার গলায় পেঁচিয়ে এষাকে মেঝের থেকে কিছুটা উঁচুতে ঝুলিয়ে রেখে। বিদ্যুতের শ্বাসরুদ্ধ দেহটা নিথর বিছানায়। এতটা অসম্মানে বাঁচা যায় না, না ছেলেটাকে বাঁচতে দেওয়া যায়। রণো নিশ্চয় পারেনি, ফিরে আসছে, ভীতু, স্বার্থপর মানুষ একটা! – এষা শেষে এটাই ভেবেছিল।
 
[ছবি - Suman]