Skip to main content

 

chobbishbar.jpg

ঋতুরাজের ভয় করে। কাশ্মীরের পহেলগামে গত বছরেই ঘুরে এসেছে। বাবা, মা, দাদু, দিদা আর সে। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ত।

ঋতুরাজ বাবা, ঠাকুর্দার কথা শোনে। প্রচণ্ড রেগে আছে বাড়ির সবাই। মুসলমান কথাটা আগেও জানত। কিন্তু এখন শব্দটা এমনভাবে বলছে সবাই, ভয় লাগছে। তার স্কুলে তার দু'জন বন্ধু মুসলমান। পারভেজ আর শাহীদ। ওদের বাবাদের ওরকম দাড়ি-টুপি নেই। দাড়ি-টুপি দেখলেই ভয় করছে ঋতুরাজের। দু'দিন আগে বাবার সঙ্গে ট্রেনে যাচ্ছিল কোন্নগর। পিসির বাড়ি। ওরকম দু'জন লোক উঠেছিল। ঋতুরাজের বারবার ইচ্ছা করছিল অন্য বগিতে চলে যেতে। ওরা কি এখনই বন্দুক বার করে তার বাবাকে গুলি চালিয়ে মেরে দেবে? কলমা পড়তে পারে না বলে? বগল, পেট, মাথা ঘেমে যাচ্ছিল ঋতুরাজের। এখন তো শাহীদ, পারভেজের সঙ্গেও কম কথা বলে। ওরাও কম কথা বলে স্কুলে। একবার আনন্দ কী একটা বলেছিল টিফিনের সময় ওদের, হেডস্যার ক্লাসে এসে খুব বকেছিলেন আনন্দকে। কী বলেছিল জানে না ঋতুরাজ। আচ্ছা, শাহীদ আর পারভেজও কী ওরকম হয়ে যাবে বড় হয়ে? মায়ের মোবাইলটা ঘাঁটে ঋতুরাজ মাঝে মাঝে। রিল দেখে। রিলে অনেক কিছু দেখাচ্ছে এখন। এগুলো আগে দেখেনি। আফ্রিকায়, লণ্ডনে, আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়, নিউজিল্যান্ডে --- আরো আরো অনেক জায়গায় এরকম হয়েছে। ওরা কেন চায় সবাই কলমা পড়তে জানুক? ওরা নাকি গোটা পৃথিবীর মানুষকে মুসলমান বানাতে চায়। ভয় লাগে ঋতুরাজের। একদিন তো তবে তার বাড়িতেও এসে মেরে দেবে তাদের। কিন্তু কাকে বলবে কথাগুলো? কাকে বলবে?

একদিন স্কুলে গিয়ে শুনল পারভেজ হাস্পাতালে ভর্তি। অ্যাপেন্ডিক্স কাটা হবে। অ্যাপেন্ডিক্স কী জানে ঋতুরাজ। পড়েছে। প্রথমেই মনে হল দেখতে যাবে ওকে। খোঁজ নিয়ে জানল নার্সিংহোমে ভর্তি, হাস্পাতালে না। কিন্তু যাবে কী করে? বাবা'কে, মা'কে --- কাকে বলবে?

স্কুল থেকে বাড়ি এল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। কী বলবে? বাবা টিভি দেখছে। মা সব্জী কাটছে। দাদু দিদা এসেছে আজ। ওরা মায়ের সঙ্গে গল্প করছে।

ঋতুরাজ বাবার কাছে গিয়ে বসল। বলল, বাবা, পারভেজ নার্সিংহোমে ভর্তি। ওর অ্যাপেন্ডেসাইটিস হয়েছে।

বাবা টিভির সাউণ্ড কমিয়ে দিয়ে বলল, সেকি! কবে?

আজকে। আমাকে কাল নিয়ে যাবে?

মা বলল, আমি নিয়ে যাব। কাল বাবার সকালে বেরোনোর আছে।

ঋতুরাজ বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকালো। কেউ বকল না কেন? বাকি সময় বেশি কথা বলল না। রাতে খাওয়ার পর ছাদে উঠল। দাদু বসে আছে। সিগারেট খাচ্ছে। তাকে দেখেই সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে বলল, প্যাসিভ স্মোকিং ভালো না।

ঋতুরাজ বলল, তুমিই বা খাও কেন?

দাদু হাসল।

ঋতুরাজ বলল, দাদু বাবা মা কী রাগ করল?

দাদু বলল, কেন?

দাদু আর ঋতুরাজ ছাদে পাশাপাশি বসে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। একটু দূরেই তো গঙ্গা।

ওরা মুসলমান বলে। ওরা আমাদের মারল কেন? আমি দেখেছি আরো অনেক দেশে ওরা করেছে। ওদের টেররিস্ট বলে। কেন করে?

দাদু বলল, তুমি গান্ধীজী পড়েছ?

ঋতুরাজ বলল, না। আমার ভাল্লাগে না। গান্ধীজী কাওয়ার্ড ছিল। সুভাষ বোস ইজ মাই হিরো। অ্যাণ্ড ভগৎ সিং।

দাদু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল দূরে। ঋতুরাজের খারাপ লাগল। এভাবে না বললেই হত।

দাদু বলল, তুমি যাদের তোমার হিরো বলছ, তারা অবশ্যই হিরো। ভীষণ সাহসী মানুষ। কিন্তু গান্ধীজী কোনোভাবেই ভীতু ছিলেন না। আচ্ছা বলো, গান্ধীজীকে তো গুলি করে মারা হয়েছিল। কোনো টেররিস্ট মেরেছিল কী?

না। নাথুরাম গড্‌সে বলে একজন মেরেছিল। আমার কাছে একটা বই আছে, গান্ধীজীর জীবনী, বাচ্চাদের জন্য। ওতে পড়েছি। কিন্তু কেন মেরেছিল বুঝতে পারিনি।

যে মেরেছিল, সে কী মুসলমান ছিল, না ইংরেজ ছিল, যাদের বিরুদ্ধে গান্ধীজী সারাটা জীবন লড়লেন?

হিন্দুই তো ছিল।

হ্যাঁ। তবেই বোঝো। তোমার কী ধারণা পারভেজ মুসলমান, আর তুমি তাকে দেখতে যাবে বলে তোমার বাবা মা রাগ করবেন? তোমার বাবা মা-কে চিনতে তোমার ভুল হয়েছে। যেমন গান্ধীজীকে। দেখো ধর্ম কীসের উপর দাঁড়িয়ে? প্রমাণ, না বিশ্বাস?

বিশ্বাস।

আরেকটা জিনিস আছে, আবেগ। ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাস আর আবেগ ভীষণভাবে জড়িয়ে থাকে। ভারতের ইতিহাস তুমি পড়েছ। সেখানে কত কত জাতির মিশ্রণ হয়েছে তুমি জানো। তুমি হোমোজেনিয়াস, হেটেরোজেনিয়াস মানে বোঝো?

হ্যাঁ, একইরকম আর নানারকম।

হুম্‌...। ভারতের ইতিহাস হল নানারকমের। আমাদের হিন্দুধর্মেই দেখো, আমিষ নিরামিষ খাওয়া নিয়ে কত বিশ্বাস। তারাপীঠে যাও, দেখবে ঠাকুরকে আমিষ ভোগ দেওয়া হচ্ছে। আবার বৃন্দাবনে যাও, সেখানে সব নিরামিষ। এগুলো বিশ্বাস। আমাদের হিন্দুধর্মে যেমন অনেক অনেক ভিন্ন বিশ্বাস আছে। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, গাণপত… আবার নিরাকার, সাকার, সগুণ, নির্গুণ। এরকম অনেক বিশ্বাস আছে। ঠিক তেমন মুসলমান, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ এদেরও নিজেদের বিশ্বাস আছে। এক সময়ে পৃথিবীতে ধর্মের বিশ্বাস নিয়ে, মতামত নিয়ে প্রচুর মারামারি হয়েছে, রক্তক্ষরণ হয়েছে। ভারতে কবীর, নানক, লালন এরা অনেকেই এই মারামারি থেকে বাঁচিয়ে দিতে চেয়েছেন আমাদের। বুঝিয়েছেন বিশ্বাস আলাদা হলেও সবাই একজন স্রষ্টাকেই চাইছে। তুমি দক্ষিণেশ্বর গেছ। রামকৃষ্ণদেবের নাম শুনেছ। সেখানে তিনি সারাটা জীবন দিয়ে বললেন, সব বিশ্বাসই পথ। যত মত….

ঋতুরাজ বলল, তত পথ। অনেকবার শুনেছি। কিন্তু ভাবিনি কখনও।

এবার থেকে ভাবতে অভ্যাস করতে হবে দাদুভাই। পড়াশোনা করতে হবে অনেক। সিনসিয়ারলি।

ঋতুরাজ বলল, বিবেকানন্দকেও আমার ভালো লাগে। কিন্তু গান্ধীজীকে না। ও নাকি বলেছিল, এক গালে চড় মারলে আরেক গাল বাড়িয়ে দাও। তার মানে কী? একজনকে যখন ওরা কাশ্মীরে গুলি করছিল, তখন আরেকজন এগিয়ে গিয়ে বলবে, আমাকেও গুলি করো? ওরা তো করেই যাবে। সবাইকে শেষ করে দেবে মেরে।

দেখো দাদুভাই, এই কথাটা গান্ধীজী বলেছে ঠিক, কিন্তু এটা আসলে যীশুখ্রীষ্টের কথা। যীশু চাইতেন মানুষে মানুষে শত্রুতা একেবারে শেষ হয়ে যাক। ধরো তোমার একজন বন্ধুর সঙ্গে খুব মারামারি হল। তুমি মার খেলে বেশি। তুমি পরেরদিন তোমার দল নিয়ে গিয়ে তাকে আচ্ছা করে মারলে। সে তারপরের আরো লোক নিয়ে এসে তোমাকে প্রচণ্ড মারল। এর কী চূড়ান্ত পরিণতি হবে বলো তো? স্কুলে আর পড়াশোনাই হবে না।

কিন্তু তাই বলে আমি মার খাব?

একদম না। কিন্তু কাউকে তো একটা থামতে হবে? তুমি তোমার বিবেচনার জোরে থেমে যাবে।

বিবেচনার জোর মানে কী?

পাওয়ার অব উইজডম। দ্য হাইয়েস্ট পাওয়ার টু বি হিউমান। দ্য সিভিলাইজেশ্যন ইজ দ্য প্রোডাক্ট অব দিজ উইজডম। দো নট পারফেক্ট, বাট স্টিল উই আর ফাইটিং ফর দ্যাট।

কিন্তু উইজডম বা বিবেচনা, যাই বলো, ওদের কেন থাকবে না?

দাদু বলল, দেখো, একটা বাড়িতে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, তুমি প্রথমেই কী করবে? আগে দমকলকে ডাকবে।

হ্যাঁ, আমাদের স্কুলের কিচেনে একবার আগুন লেগে গিয়েছিল….. দমকল এসেছিল….

তবে তো তুমি জানোই। আচ্ছা বলো দাদুভাই, দমকল কী নিয়ে এসেছিল, আগুন, না জল?

অবভিয়াসলি জল…..

হ্যাঁ। না হলে কী হত বলো তো? সবাই পুড়তে। আগুন যে লাগায় তাকেও পোড়ায়, জানো তো। কে হিন্দু, কে মুসলমান কাউকে দেখে না। তাই দমকল এল। জল এল।

হ্যাঁ…. ঠিক

তোমার স্কুলেও দেখবে অনেকে ভীষণ দুষ্টু। বুদ্ধিমান হয় তো, ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু খুব দুষ্টু। অনেকে অল্প দুষ্টু। কেউ ভালো। কেউ খুব শান্ত। কেউ বুদ্ধিমান আর সবাইকে নিয়ে চলতে চায়।

হ্যাঁ…. প্রকাশ রাউত, ওকেই মনিটার হিসাবে ভালো লাগে আমার…. ক্লাস দারুণ ম্যানেজ করে। আর পল্লব কী করে জানো, ও একটু কথা বললেই নাম টুকে স্যারেদের বলে, ইগজিজারেট করে, থ্রেট করে। কিন্তু ওর ক্লোজ বন্ধুদের কিচ্ছু বলে না।

হ্যাঁ, সমাজেও তাই। দেখো, তুমি তো আর সব দুষ্টু ছেলেদের স্কুল থেকে তাড়াতে পারবে না। তোমাকে তো সবাইকে নিয়েই চলতে হবে। তাই একজন ভালো মনিটরের দরকার।

গান্ধীজী কি তাই?

দেখো ভালো মন্দ তো লোকে বলবেই। কিন্তু গান্ধিজী আসলে বুঝেছিলেন আমাদের সমস্যাটা কোথায়? হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে এই সংঘাত, উনি এর মূল অবধি যেতে চেয়েছিলেন। একের অন্যের উপর বিদ্বেষ মূল থেকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। নিজের জীবন বিপন্ন করেও। তুমি গান্ধীজীর নোয়াখালী অধ্যায়, বেলেঘাটা অধ্যায় পড়ে দেখবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কীভাবে জীবন বিপন্ন করেছিলেন। মারাও যেতে পারতেন। গেলেনও তার জন্যেই। কিন্তু আমরা গান্ধীকে সরিয়ে দিয়ে অন্য কোনো রাস্তা কি পেয়েছি? পাইনি। সব দেশের কাছে আজকে নিউক্লিয়ার উইপন আছে। সব দেশের কাছে সাংঘাতিক সব মারণাস্ত্র আছে….

মারণাস্ত্র কী?

সফিস্টিকেটেড উইপন টু কিল আ সিভিলাইজেশ্যন হুম ইউ থিংক ইওর এনিমি….. তুমি কী চাও পারভেজকে কেউ মেরে দিক… ও মুসলমান বলে? ওকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিক…..

ঋতুরাজ চমকে উঠল। বলল, হাউ ইভেন ইউ ক্যান সে দ্যাট…. হি ইজ মাই ওয়ান অব মোস্ট ফেভারিট ফ্রেণ্ড…. অ্যান্ড ইউ ডোন্ট নো হাও মাচ অ্যাশেমড হি ইজ…. আই ইভেন কান্ট লুক অ্যাট হিজ আইজ…… নাও হি ইজ সিক…. হি ডাজন্ট হ্যাভ ফাদার…. হাও ইউ ক্যান সে দ্যাট…. হাও হাও….

ঋতুরাজের গলা ভেঙে এল। দুটো হাত মুখের উপর রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে উঠে গেল। ছাদের ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

দাদু এসে ওর পিঠে হাত রেখে বলল, আই অ্যাম সরি…. আই ডিডন্ট মিন টু হার্ট ইউ….. মহাত্মা ক্রায়েড লাইক দ্যাট…. অ্যাজ ইউ নো পারভেজ ইজ আ গুড গাই… অ্যান্ড হি ডিজার্ভ ডিগনিটি, প্রোটেকশান…. সো উই অল। ইন্দিরা গান্ধী অ্যাসাসিনেশানের পর দেশ জুড়ে শিখ হত্যা শুরু হয়েছিল। তোমার বাবার একজন বন্ধু ছিল শিখ। তারা আমাদের বাড়ি লুকিয়েছিল একমাস। হ্যাট্রেড আর পলিটিক্স আ ডেডলি কম্বিনেশন ডিয়ার। দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট গোয়িং টু বি ফ্রি এনি অব দ্যাট প্র‍্যাক্টিকালি…. সো মহাত্মা ইজ আওয়ার ওয়ান অ্যাণ্ড ওনলি হোপ ডিয়ার…. জাস্ট স্টাডি হাও আইনস্টাইন, চ্যাপলিন টু অল গ্রেট সোল অ্যাডমায়ার হিম.. আই অ্যাম নট সেয়িং হি ইজ ফ্ল লেস… ইটস নট পসিব্‌ল… উই অল আর হিউম্যান…. বাট হি শোজ আস দ্য ওয়ে…. উই ক্যান ওনলি ইগনোর হিম অন দ্যাট ডে হোয়েন উই হ্যাভ গট অ্যান অলটারনেটিভ…. হুইচ স্টিল উই হ্যাভ নট….. চোখ মোছো দাদুভাই….. এসো নীচে যাই…..

হুম চলো।

ঋতুরাজ ডিনারের পর ঘরে এল। মা কাল নিয়ে যাবেন নার্সিংহোমে। গাড়ি বলা হয়ে গেছে। ঋতুরাজ বইয়ের তাকের একদম নীচ থেকে লাইফ অব মহাত্মা গান্ধী, অ্যাব্রিজড, বাই লুইজ ফিশার বইটা বার করল। পড়তে হবে।